১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গল্প শুধু গল্প নয় চারাগল্প

-

আমি জানতাম কোনো দিনও আমাদের সম্পর্কটা পরিবার মেনে নেবে না। কারণ অর্ণব ছিল হিন্দু। সত্যি কথা বলতে, অর্ণব ছাড়া একটি পৃথিবী কেমন হতে পারে? আমি ওটা কল্পনায়ও আঁকতে পারতাম না। তাই ভবিষ্যতের কথা না ভেবেই ওকে নিয়ে পাড়ি জমালাম নিষ্ঠুর শহরে। ছাড়লাম আপন পরিবার। অতিথি পাখির মতো ছোট্ট একটি বাসা নিয়ে নতুন করে বাঁচতে শুরু করলাম আমরা। এত্ত সব কষ্টের মাঝেও আমাদের ছিল অন্য রকম একটা সুখ। কিছু দিন পর অর্ণব সুন্দর একটা জবও পেয়ে গেল। তারপর বেশ ভালোই যাচ্ছিল আমাদের দিনগুলো। যদিও আব্বু আম্মু ছোট ভাইটিকে মনে করে মাঝে মধ্যে খুব বেশি কষ্ট হতো। তবুও থেমে থাকেনি সময়টা। এক-একটি দিন করে কেটে যায় দুটো বছর।
একদিন এমন দিনও নেমে আসবে ভাবিনি, অর্ণব আমাকে অফিসের ব্যস্ততা দেখাতে আরম্ভ করল। ফোন দিলেই বলত ‘অফিস টাইমে তোমাকে কত্তবার নিষেধ করেছি ফোন দিতে?’ কিন্তু ওর কথার সুরে আমি বুঝতে পারলাম আমার কী-ই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তারপর আমি অফিসের একজনের সাথে গোপনে যোগাযোগ করলাম। জানতে পারলাম দুই মাস হয়ে গেছে, অর্ণব স্মৃতি নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। ওই কোম্পানিতেই চাকরি করে মেয়েটি। মেয়েটিও হিন্দু। আজকাল অর্ণবের বাড়িতেও যোগাযোগ আছে। স্মৃতি আর ওর বিয়ের ব্যাপারটাও নাকি বাড়ির লোকজন জানে। তখনই ভেবেছিলাম সুসাইড করব। তবুও কেন যেন পারলাম না। কে যেন পারতে দিলো না আমায়।
কিছু না ভেবেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ভাবলাম কিছু উত্তর পাওয়ার জন্য হলেও আমাকে সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে ক’টা দিন। কোথায় কমতি ছিল আমার? কী করিনি আমি ওর জন্য? প্রশ্নগুলো পুষে রাখলাম খুব নীরবে-সঙ্গোপনে। কোনোরকম বেঁচে থাকার জন্য একটা গার্মেন্টসে চাকরি নিলাম। নতুনভাবে দিন গুনতে শুরু করলাম আবার। প্রথম ক’দিন অর্ণব খুব ফোন দিয়েছিল। কিন্তু আমি আর রিসিভ করিনি। আমি অর্ণবকে খুব বেশি ভালোবাসতাম তাই ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করিনি সে দিন। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু মাঝে মধ্যে এটাকে জীবন মনে হতো না আমার। পেছনের স্মৃতিগুলো মনে হলে ভেঙে পড়তাম আমি। প্রতিদিনই ভাবতাম আজই হয়তো আমার জীবনের শেষ দিন। কালই সুসাইড করব। সব কিছু গুছিয়েও নিতাম ওভাবে। কিন্তু পারা হয়ে ওঠেনি।
নয় মাসের মধ্যে অর্ণবের কোনো ফোন পাইনি। এই সপ্তাহ দুয়েক আগে ওর ফোন পেলাম। মোবাইল স্কিনে নম্বরটা দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। তবুও ভেবেছিলাম রিসিভ করব না। কিন্তু তার পরও খুব জানতে ইচ্ছে করছিল; কেমন আছে ও? রিসিভ করলাম আমি। ওপাশে থেকে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো। বুঝলাম স্মৃতিই হবে। একটু হাসির ভণিতা মেখেই জানতে চাইলাম ‘কেমন আছো?’ ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলার কণ্ঠে, ‘আমি শ্যামলীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে বলছি; আপনাকে এখনই একটু হাসপাতালে আসতে হবে।’ আমি বুঝতে পারলাম অর্ণব হয়তো ভালো নেই। তখন একদম কিছু না ভেবেই হাসপাতালে চলে গেলাম।
প্রায় এক বছর পর অর্ণবের সাথে দেখা। অর্ণব হাসপাতালের শুভ্রবেডে শুয়ে আছে। আমাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আগের মতোই সান্ত্বনা দিলাম। শুনলাম সেই চাকরিটা আজ নেই। স্মৃতিও চলে গেছে। অর্ণব আজ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এখন ওর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার। কোথায় পাবো এত টাকা? অর্ণবের বাড়িতেও খবর দিয়েছি কিন্তু কেউ আসেনি। আমার জমানো যা কিছু ছিল খরচ করলাম। আম্মুর দেয়া একটা স্মৃতি ছিল আংটি; সেটাও বিক্রি করলাম তবু অর্ণবের প্রয়োজনের তুলনায় এটুকু একেবারে অপ্রতুল।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 


আরো সংবাদ



premium cement