১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৌন্দর্যে ঘেরা মারুকা বিল

-

বিলের নাম ‘মারুকা বিল’। চৈত্র-বৈশাখে যেখানে বসে সোনালি ধানের মেলা। বর্ষা আসতে না আসতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে চার দিক। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত থৈ থৈ করে বিস্তীর্ণ জলরাশি। অন্য ঋতুর তুলনায় তখন বিলের সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহু গুণ। নতুন জলে সাঁতার কাটে নানা রঙের বালিহাঁস। শাপলার শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ে শেষ দিগন্ত পর্যন্ত। নিটোল জলে ছুটে বেড়ায় ছোট-বড় পালতোলা অসংখ্য নৌকা। কখনো দেখা মেলে গয়নার ভেতর ঘোমটা দিয়ে নতুন বউ যাচ্ছে নাইয়রে। বিলের এমন মনকাড়া সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটির দিনে শহর থেকে ছুটে আসেন শত শত পর্যটক। হেঁটে হেঁটে পায়ের আল্পনা আঁকেন বালুচরে। হারিয়ে যান শুভ্র কাশবনে। প্রেমিক তার প্রিয়জনের এলোকেশে পরিয়ে দেন কদমফুলের মালা। বিলের চার পাশের সারি সারি ঘন গাছপালা প্রকৃতিপ্রেমীর মনকে টেনে নিয়ে যায়। ছোট ডিঙি নৌকা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়েন কেউ কেউ। বিলের মাঝ দিয়ে চলে গেছে সরু একটা রাস্তা। একটু এগোলেই দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন একটি ছোট ব্রিজের। পর্যটকেরা মনের আনন্দে সময় কাটান ব্রিজে উঠে। কথায় কথায় জমে ওঠে আড্ডা। মাঝেমধ্যে চলে ফুচকা, চটপটির আসর। জামা খুলে কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়েন পানিতে। সাঁতার কাটেন মনের আনন্দে।
বিলটিকে ঘিরে আমার স্মৃতিগুলো খুব পুরনো। কারণ, আমার দুরন্তময় শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এ গ্রামেই। বর্ষা এলে আনন্দের সীমা থাকত না আমার। মায়ের শাসনের তোয়াক্কা না করে বন্ধুদের সাথে ভিজতাম ঝুম বৃষ্টিতে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে নতুন জলে দাপাদাপি করতাম অনেকটা সময় ধরে। বিকেলে ছোট নৌকা নিয়ে ছুটতাম শাপলাবনে। সারি সারি শাপলা আর পদ্মফুলগুলো ছোট বয়সেও মনের ভেতর এক ধরনের মুগ্ধতা সৃষ্টি করত। শাপলার ঢ্যাপ দিয়ে খই বানিয়ে খেতাম দলবেঁধে। কখনো হারিয়ে যেতাম কলমিবনে। তুলে আনতাম সাদা সাদা কলমিফুল। বিলের এক ধারের হিজলবনটি অর্ধেকটা ডুবে যেত পানিতে। বড়শি হাতে নৌকায় করে কখনো চলে যেতাম সেখানে। হিজলগাছের ছায়ায় বসে ধরতাম কৈ, মাগুরসহ নানা মাছ।
মারুকা বিলটি কেবল দৃষ্টিনন্দনই নয়; অনেক মানুষের আয়ের উৎসও এটি। নতুন পানির সাথে ভেসে আসে ছোট-বড় প্রচুর মাছ। রুই, কাতলা, বোয়াল, সরপুঁটি, পুঁটি, কৈ, মাগুর, শোল, খলশে, টেংরা, চিংড়ি, বুঁইচা আরো কত কী! নানা পদ্ধতিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন এখানের মানুষ। এ বিলে মাছ ধরার যে পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়, তা হলো ‘ধর্মজাল’। মোটা একটা বাঁশের মাথায় চারটে চিকন বাঁশে জাল লাগানো হয়। এরপর মোটা বাঁশের পেছন অংশ টান দিলে সামনের অংশ ওপরে উঠে আসে। মাছের কিলবিল তখন হয় দেখার মতো। জালের ভেতর মাছগুলোর ছোটাছুটির দৃশ্য খুবই সুন্দর দেখায়। এ ছাড়া কারেন্ট জাল, টেঁটা, বড়শি ও বিভিন্ন জাল দিয়ে ধরা হয় মাছ। বিকেলে রাস্তার ধারে বসে মাছের বাজার। বিক্রেতা দাম হাঁকান জোর আওয়াজে। দামে বনলে কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন পথচারী। কখনো কখনো বিলের তাজা মাছ কিনতে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়।
শীতের শুরুতে যখন বিলের পানি নামতে শুরু করে, তখন মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। হাড়কাঁপানো শীতের সকালে ডেগচি বা মাছ রাখার পাত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। কম পানিতে হাতড়ে মাছ ধরা যায়। কেউ কেউ ধানের জমিতে আগে থেকেই গাছের ডালপালা ফেলে রাখেন। পানি কমে গেলে জমির সেচে করে পান প্রচুর মাছ। কেউ কেউ পুরনো নৌকা কয়েক দিন ডুবিয়ে রেখেও ধরেন মাছ।
বিলের এক পাশে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘের বানিয়ে তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি মাছের প্রজেক্ট। বিলের মাছের সাথে তাতে ছাড়া হয় রুই, কাতলা, তেলাপিয়া ইত্যাদি বড় মাছের পোনা। অল্প ক’দিনেই মাছ বড় হয়ে খাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে। যেদিন মাছ ধরা হয়, সেদিন হয় মানুষের উপচে পড়া ভিড়। প্রজেক্টের মালিক প্রচুর টাকা আয় করেন মাছ বিক্রি করেই।

 


আরো সংবাদ



premium cement