২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বন্ধু হয়ে পাশে ছিলাম, আছি

-

তাবাসসুম আমার বন্ধুর নাম, প্রিয় বন্ধুর নাম। ওর সাথে পরিচয় আজ থেকে তেরো বছর আগে। ও আমার যেমন বন্ধু এমন বন্ধু আর একটাও নেই। ছোটবেলা, স্কুলবেলা বা কলেজবেলায় আমার কোনো প্রিয়বন্ধু ছিল না। স্কুলে ছেলেমেয়ে একসাথে পড়লেও কলেজ ছিল, মহিলা কলেজ (লালমাটিয়া মহিলা কলেজ)। স্কুলবেলায় আমি খুব দজ্জাল ছিলাম বলে সবার সাথে একইভাবে মিশতাম, কাউকে প্রিয়বন্ধু করিনি। কলেজ সময়ে তাহমিনা আর মনি নামে দুইজন ভালো বন্ধু ছিল। তবে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়। তাহমিনার কোনো খবর জানি না। মনির বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করে সাজু ভাইয়ের সাথে। চলতে পথে খুঁজি ওদের কিন্তু পাইনি।
তাবাসসুম আমার বড় মেয়ে রৌদ্রের বান্ধবীর আম্মু। রৌদ্র যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে, তখন তাবাসসুমের সাথে আমার পরিচয়, বন্ধুত্ব। এখন সে আমার খুব খুব খুব ভালো বন্ধু। সাত বছর আমাদের মেয়েরা একসাথে স্কুল করেছে। সাত বছরে ২৫৫৬ দিন হয়। যদি দুই হাজার দিন স্কুলে ক্লাস হয়ে থাকে। হয়তো ১০০ দিন ওর মেয়েরা ক্লাস শুরুর আগে অ্যাসেম্বলি করতে পেরেছে। ও সবসময় স্কুল আসতে দেরি করে, আর এই জন্যেই ওর নাম দিইÑ লেটুস। আমাদের চার মায়ের সাত মেয়েসহ আমরা ছিলাম ১১ জন। নিজেদেরকে আমরা ক্রিকেট টিম বলতাম। আমার দুই মেয়ে তাবাসসুমের দুই মেয়ে আশার দুই মেয়ে আর রাহেলার এক মেয়ে। ২০১২ সালে তাবাসসুমের ছোট মেয়ে হার্টের সমস্যায় মারা যায়, তখন ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত। আমাদের ক্রিকেট টিমের একজনকে হারিয়ে আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। তাবাসসুমের সামনে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়েছি আমি। হাজার কষ্টকে সামলে নিয়ে তাবাসসুম দাঁড়াতে চেষ্টা করে। অনেকটা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে একদিন এসে আমায় বলেÑ
মৌ সামান্য মূলধন দিবি, কিছু ড্রেস এনে বিক্রি করব।
দিলাম, তাবাসসুম শুরু করল কাজ। সাথে সাথে হাতের তৈরি খাবারের অর্ডার নেয়। ঘরোয়াভাবে শুরু করে। ঠিক সেই সময়ে ওর হাজবেন্ডের চাকরি চলে যায়। উনাকে আমি বড় ভাই বলে জানতাম। ভাইয়ের হার্টে আগে থেকেই রিঙ পরানো। পরিবারের একমাত্র চাকরিজীবী চাকরি হারিয়ে পুরো সংসার অচল। অনেক জায়গায় ভাইয়ের জন্যে আমি নিজে চাকরি খুঁজেছি, পাইনি। এখন তরুণদেরকে সবাই কাজে নিতে চায়, ভাই সামান্য বিএ পাশ, চাকরি কে দিবে। তাবাসসুম হুঁশ হারায়, কী করবে? মেয়ে অনার্সে ভর্তি হলো, ওর খরচ, সংসার আর ঢাকা শহরের বাসা ভাড়া। ভাইয়ের দিকের অনেকেই উচ্চবিত্তের কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। তাবাসসুমের বাবার বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো না। মেয়েকে হারানোর পর হারায় মা ও বাবাকে।
ওদের বাসার কাছে ছোট একটা দোকান ভাড়া হচ্ছে, তাবাসসুম এসে আমাকে জিজ্ঞাস করে নিবে কিনা। নিলে পুঁজি লাগবে। সে দোকানটাকে বুটিকস ও টেইলার্সের কাজ করবে। আমি বেকার গৃহিণী মানুষ, সামান্য লেখালেখি করি। টাকা কোথায় পবো। তবুও কিছু পুঁজির ব্যবস্থা করি। শুরু করে দোকান। দোকানের পজেশন বাবদ এককালীন দুই লাখ টাকা দেয়া লাগবে। কিন্তু এত টাকা ও কোথায় পাবে। আগে যার কাছে পজিশন দেয়া ছিল তাকে সেই দুই লাখ টাকা দিতে হবে।
তাবাসসুম না দিতে পারায় বাড়ির মালিক অন্য কারো কাছ থেকে দুই লাখ টাকা এনে দেয়। সেই দুই লাখ টাকার সুদ প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা দিতে হতো তাবাসসুমকে। দোকান ভাড়া ও সুদের টাকা দিয়ে ভাতডাল খেয়ে থাকাই ওদের কষ্টের। মেয়েটা দুই-তিনটা টিউশনি করে বাবা মাকে সাহায্য করছে। যার সংসার চলে না, সে কিনা সাত হাজার করে সুদ দিয়ে যাচ্ছে, এটা আমার কাছে বিষাক্ত গলার কাঁটার মতো লাগতে থাকে।
কম সুদে দুই লাখ টাকার জন্য আমি ব্যাংকেও যাই, তারা বাড়ির দলিল বা দামি কিছু চায়। আশপাশের অনেক বড় লোকের কাছে হাওলাত চেয়েছি এই বলে যে সুদ দেবো না, প্রতি মাসে আট-দশ হাজার করে দিয়ে আসল শোধ করব। কারো কাছে পাইনি। চিন্তায় ঘুম আসে না আমার। বুদ্ধি হলো একজনের কাছে না পাই কয়েকজনের থেকে নেবো, তবুও তাবাসসুমকে সুদমুক্ত করব।
আমার মা তিনিও গৃহিণী, তার কাছে তেমন টাকা নেই। মায়ের সাথে কথা বলে মা, ভাই, বোন আর আমি সবার থেকে নিয়ে দুই লাখ টাকা জোগাড় করলাম। তুলে দিলাম তাবাসসুমের হাতে, বললামÑ
‘যে টাকা তুই সুদ দিতি, সে টাকায় এখন আসল শোধ কর।’
তাবাসসুম এখন প্রতি মাসে ৫-৬-৭ হাজার করে টাকা দেয় আমি আমার সেই আসলের টাকা শোধ করি। শান্তির নিঃশ্বাস ফেলি এই বলে, তাবাসসুমের সুদ দিতে হয় না, ওর জন্য সুদবিহীন আসলের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। ভাই একজায়গায় ১০ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। এই সময়ে ১০ হাজার টাকায় কী হয়, তাবাসসুমদের অনেক কিছু হয়। ঘরে থেকে যে মানসিক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল ভাই, তা দূর হলো।
তাবাসসুমের মেয়ের পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে ৩৫ হাজার টাকা লাগবে। এ দিকে আমি গ্রামে যাব, কী করবে তাবাসসুম। ওর হাতে তখন ১৫ হাজার টাকা, যা মেয়ে টিউশনি করে জমা করেছে। গ্রামে যাওয়ার আগের দিন রাতে ওর হাতে ১০ হাজার টাকা দিয়ে যাই, বলি-
‘চেষ্টা তো করেছিস টাকা কমাতে, না পারলে তো টাকা দিতে হবে। তখন কী করবি, এই নে।’
তাবাসসুম অশ্রু ফেলে, ফেলি আমিও। বন্ধুর জন্য বন্ধুর পাশে থাকার জল ছিল সেদিন দু’জনের চোখে। ওই টাকার সাথে আরো টাকার ব্যবস্থা করে কলেজে জমা দেয়। কেন তাবাসসুম আমার সেরা বন্ধু এটা নিজেই ভাবি, পেয়েছি জবাব। ওর সততা, নীতি, আদর্শ, সহজ মানসিকতার জন্যই ও আমার প্রিয় বন্ধু, ভালো ও সেরা বন্ধু। তাবাসসুমকে শুধু একটা কথাই বলব আজ-
‘বন্ধু হয়ে তোর পাশে ছিলাম, আছি’।

 


আরো সংবাদ



premium cement