২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঐতিহ্যের জামদানি শাড়ি

-

বুনন আর নকশার জন্য আমাদের দেশে জামদানি শাড়ির কদর সেই প্রাচীনকাল থেকেই। সব বয়সী নারীর কাছে রয়েছে জামদানি শাড়ির চাহিদা। এ কারণে জামদানি শাড়ির বেচাকেনা সারা বছরই চলে সমানভাবে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার গোড়াপত্তনের আগেই নারায়ণগঞ্জে জামদানি শাড়ির প্রচলন শুরু হয়েছিল।
প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের অতিপরিচিত। মসলিনের ওপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। বর্তমানে জামদানি বলতে সাধারণত শাড়িকেই বোঝানো হয়। এক সময় জামদানি দিয়ে নকশি ওড়না, পাগড়ি, কুর্তা ও পর্দা প্রভৃতি তৈরি হতো।
ঢাকাই জামদানির ইতিহাস ঢাকার ইতিহাসের চেয়েও পুরনো। ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান যখন তার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন, তখনই ঢাকার ইতিহাসের জন্ম। অথচ জামদানির ইতিহাস তার চেয়েও পুরনো। ঢাকার মসলিন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সম্ভবত মুসলমানেরাই জামদানির বুননকর্মটির প্রচলন করেন এবং এখনো অতীত ঐতিহ্যকে ধরে টিকে রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকেও বঙ্গ থেকে সোনারগাঁও বন্দরের মাধ্যমে মসলিনের মতো সূক্ষ্ম বস্ত্র ইউরোপে রফতানি হতো। কেননা ঢাকার সোনারগাঁও, ধামরাই, বাজিতপুর ছিল জামদানি ও মসলিন কাপড়ের জন্য ঐতিহাসিক স্থান। জামদানি শাড়ির প্রকৃত অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল মধ্যযুগের মুসলিম আমলেই। আসলে পারস্য ও মুঘলÑ এ দু’টি মিশ্র সংস্কৃতির ফসল এই শাড়ি। প্রাচীনকাল থেকেই এ ধরনের কাপড় তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় বরাবর পুরনো সোনারগাঁও অঞ্চলটিই ছিল ব্যাপক উৎপাদন কেন্দ্র। বর্তমানে রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও এবং সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলায় জামদানির কাজ হলেও সোনারগাঁও উপজেলা জামদানিপল্লী হিসেবে সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত রয়েছে। মূলত মুসলিম কারিগররাই ছিলেন এ কাজে বিশেষ পারদর্শী। এখনো মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক এই শিল্পের দক্ষতার সঙ্গে জড়িত। প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিতে না পারায় জামদানিশিল্পীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালের পরিসংখ্যানে এখানে এক লাখ ৩০ হাজারের মতো জামদানিশিল্পী ছিলেন, যা বর্তমানে অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে। জামদানি শাড়ি তৈরি করে এখানকার কারিগরেরা খেয়ে-পরে খুব ভালোভাবেই জীবন যাপন করতেন। বর্তমানে এ পেশা বাদ দিয়ে তাঁতশিল্পীরা বিদেশমুখী হওয়ায় এ কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য দিকে এ কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের অভিযোগÑ অন্যান্য পেশায় মজুরি বাড়লেও বাড়েনি জামদানি বুননশিল্পীদের মজুরি। আর যারা শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কাজ করাচ্ছেন তারা অভিযোগ করছেন, একটি শাড়ি বুননে দু’জন শ্রমিকের ২০ থেকে ৩০ দিন লাগে। আর এর পেছনে যে ব্যয় হয় পরবর্তী সময়ে শাড়ি বিক্রি করে যে দাম পাই তাতে টিকে থাকা কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে একসময় বন্ধ হয়ে যাবে শিল্পটি।
মাত্র দুই যুগ আগেও নারায়ণগঞ্জ শাড়ি উৎপাদন করে উন্নত জীবন যাপন করতেন এ পেশার সাথে জড়িতরা। এখানকার প্রতিটি ঘরেই চালু ছিল একাধিক তাঁত আর তাঁতের মাধ্যমে উৎপাদিত জামদানি শাড়ি বিক্রি করে এ এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা চলত। সামান্য সময়ের ব্যবধানে আজ শিল্পটি বন্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে বলে অভিযোগ করেন জড়িত বুননশিল্পী ও মালিকেরা। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার গঙ্গাপুর এলাকার আবুবকর সিদ্দিক জানান, বাজারে জামদানি শাড়ির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে, কিন্তু জামদানি শাড়ির উৎপাদন ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। আর যেসব তাঁত এখনো চালু রয়েছে তা কোনো রকম টিকে আছে।
বাইসটেকি এলাকার কারিগর আবদুল মালেক জানান, আগে একটি শাড়ি বুনিয়ে যে টাকা পেতাম, তাতে ভালোভাবেই সংসার চলে যেত। বর্তমানে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের বেশির ভাগ তাঁত চলে মাসিক চুক্তিশ্রমিক দিয়ে। যে কারণে মালিক-শ্রমিক কেউই এ জামদানি উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছেন না।
তার পরও নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে যারা টিকিয়ে রেখেছেন, তারাও সঙ্কায় রয়েছেন এর অস্তিত্ব নিয়ে। বর্তমানে উৎপাদিত জামদানি তৈরিতে ২০ থেকে ১০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার হয়ে থাকে। সুতার সূক্ষ্মতা আর নকশার বৈচিত্র্যের ওপরই নির্ভর করে দামের বিষয়টি। একটি শাড়িতে যত বেশি নকশার কাজ হবে, তত বেশি আকৃষ্ট করবে ক্রেতার মন। শাড়ির আঁচল, পাড় আর জমিনের নকশার ওপরও জামদানির চাহিদা নির্ভর করে। জামদানি উৎপাদনকারীরা নকশার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে শাড়ি তৈরি করছেন। এ ছাড়া, জামদানির পুরনো নকশার মধ্যে রয়েছেÑ করলা, দূর্বা, জুঁইফুল,কণকতারা, গজমতি, আশরাফি, নয়ন-সুখ, সন্দেশ, প্রজাপতি, ঝিঙেফুল, মটরদানা,শঙ্খমতি রাইমা, কলমিলতা, সাবুদানা, ডালিম, আদারদানা, হানাই, জালিবাইন, মাকড়সার জাল, দুবলি জাল, নয়নবাহার, মটর জাল, পানকি, কান্দি, কলসা, পোনা, গোলাপচর, টাঙ্গাইলস, ময়ূর পেখম, সজনী, কাজল লতা প্রভৃতি। এক সময় নির্দিষ্ট কয়েকটি রঙের ওপর তৈরি হতো শাড়ি। এরপর করা হতো নকশার কাজ। এখন সব ধরনের রঙের মিশেলে তৈরি হয় শাড়ি আর নকশার কাজে ব্যবহার করা হয় সুতি, সিল্ক ও জরির সুতা।
উৎপাদিত জামদানি শাড়ি বিক্রির প্রসিদ্ধ হাট ছিল রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া। বর্তমানে ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীতীরের বিসিক শিল্প নগরীতে হাট বসে। প্রতি শুক্রবার সকালে হাট বসে চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। হাটের পাশেরই গড়ে উঠেছে মার্কেট। বিক্রয়কেন্দ্রে সারা মাস জামদানি বিক্রি হলেও জামদানির হাটে সপ্তাহের এক দিন শুক্রবার শাড়ি বিক্রি করেন তাঁতিরা।
বিশ্বঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শিল্প। জামদানি আমাদের দেশের ঐতিহ্য আর এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই সরকারকে সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে দেশীয় এই জামদানি শিল্প।


আরো সংবাদ



premium cement