২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মক্কা-মদিনার শান্তি আর ঐতিহ্য

মসজিদে কুবার সামনে লেখক -

ছোট থেকে মক্কা-মদিনার কথা শুনে আসছি। চোখে দেখিনি। প্রতিটি মুসলমানের মতো মক্কা-মদিনায় গিয়ে পবিত্র কাবা তাওয়াফ, মসজিদে নববীতে নবী মুহাম্মদ সা:-এর রওজা মোবারক জিয়ারত এবং ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রশান্তির পরশ পাওয়ার তীব্র বাসনা তাড়া করত। অবশেষে ১৬ মে, ২০১৮ তারিখে কাবার মালিক আল্লাহর তার অনুগ্রহে মদিনার পথে যাত্রার সুযোগ হলো। শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিকেল সাড়ে ৪টায় সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে পবিত্র নগরী মদিনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি আমরা। পথে দাম্মাম বিমানবন্দরে দশ মিনিটের যাত্রা বিরতি শেষে ঘণ্টাখানেক পরই মদিনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের মাধ্যমে পবিত্র নগরীর ছোঁয়া পেয়ে মন-প্রাণ শিহরিত হয়ে ওঠেছিল। সৌদি আরবের স্থানীয় সময় মধ্য রাতের কিছু সময় পরই এয়ারপোর্ট থেকে মোয়াল্লেম মুফতি জোবায়ের সাহেব বাসে করে বিভিন্ন রাস্তা ও ইহুদ পাহাড়ের পরিচয় বর্ণনার মাধ্যমে মসজিদে নববীর হেরেমের কাছেই আমাদের ষোলো জনের কাফেলাকে একটি আবাসিক হোটেলে নিয়ে গেলেন। অবশ্য দূর থেকে মসজিদে নববীর সুউচ্চ মিনারের দেখা পেয়েছিলাম। হোটেলে ওঠেই সবার গন্তব্য মসজিদে নববীতে গিয়ে রাসূলে করিম হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাম প্রেরণ করে মনের আকুতি পূরণ করা। তাই হলো। নবীজীর রওজার সামনে গিয়ে সালাম প্রেরণ করতে গিয়েই আনন্দভরা আবেগে দুই চোখের পানি আর বাধা মানল না। নবীজীর পাশেই শুয়ে আছেন তার প্রিয় সাহাবি হজরত আবু বকর রা: ও হজরত ওমর ফারুক রা:। কথিত আছে, সেখানে আরো একটি কবরের জায়গা খালি আছে, সেখানেই ইমাম মেহেদি আ:-এর কবর হবে। নবীজী ও তার প্রিয় দুই সাহাবির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়ার মুহূর্তগুলোর আওয়াজ এখনো চোখে টলমল করে। এভাবেই কেটে গেল ছয়টি দিন। এর মধ্যে বিশ্বনবীর হাজারো সুখদুঃখের স্মৃতিবিজড়িত শান্তির নগরী সৌদি আরবের পশ্চিমের শহর হেজাজ নগরীর রাজধানী প্রিয়নবীর শহর পবিত্র মদিনা, এ নগরীতেই রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যে আর ত্যাগের মহিমায় ঘেরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান। মসজিদে নববীর পাশেই নবীজীর দুঃখের দিনের সঙ্গী নবীজীর প্রিয়তমা স্ত্রী মা খাদিজা রা:, হজরত ওসমান রা:সহ ১০ হাজার সাহাবির কবর নিয়ে জান্নাতুল বাকী। পবিত্র নগরী মদিনায় হিজরতের পর রাসূল সা: কর্তৃক নির্মিত প্রথম মসজিদÑ মসজিদে কুবা। মদিনার খুব কাছেই জিয়ারত করতে পারেন শুহাদায়ে উহুদ। মুসলিম বীর সেনানি নবীজীর চাচা হজরত আমির হামজার রা:সহ অনেকেই উহুদ প্রান্তরেই শায়িত আছেন। চার দিকে ঘেরাও করা আমির হামজার কবরসহ অন্যদের কবর। পাশেই রুম্মান পাহাড়। উহুদ প্রান্তরে আমির হামজার কবর, সেখানে জিয়ারত করে চার দিকে বিশাল বিশাল পাহাড় দেখে আপনি বিস্মিত হবেন। আমির হামজার কবরের পাশেই জিয়ারতের জায়গায় বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় কবর জিয়ারতের ফজিলত ও শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ বা বিদআতের বিষয়গুলো লেখা রয়েছে বিশাল সাইনবোর্ডে।
মসজিদে নববীতে বর্তমানে একত্রে ২০ লক্ষাধিক মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদে নববীতে ১০টি মিনার, ৮টি ফোল্ডিং ছাতা ও ২৭টি গম্বুজ এবং ৭টি প্রবেশপথ ও ৮২টি দরজা রয়েছে। মহানবীর হুজরাহ মোবারকেই মহানবী সা:-এর দেহ মোবারক শায়িত আছেন। পবিত্র রমজান মাসে মসজিদে নববীর ইফতার অনুষ্ঠানের শৃঙ্খলা-হৃদ্রতা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মসজিদে নববীর ভেতরে-বাইরে লাখ লাখ মুসল্লির মিলনমেলায় বাহারি ইফতারের আয়োজন হয়। ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগেই সারিবদ্ধ হয়ে নানা জাতির মুসলমানেরা বসে যান। নান্দনিক ইফতার চাহিদার চেয়ে কয়েক গুণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মদিনায় অসংখ্য বাংলাদেশী হোটেলে বাংলা খাবার ইচ্ছা করলেই খেতে পারবেন। বাংলায় সাইনবোর্ড দেয়া হোটেল মদিনা, হোটেল জমজম, হোটেল মোহাম্মদিয়া, ঢাকা হোটেলসহ আপনি অসংখ্য হোটেল থেকে ডাক পাবেন, “ভাই আসেনÑ ‘দেশী টাটকা খাবার’ আসেন ভাই আসেন”। মে মাসে মদিনার গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৬ সে. এবং সর্বনিম্ন ২৫.৫ সে.। নভেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়। গত ২১ মে, ২০১৮ বাদ আসর মেঘের গর্জনসহ মদিনার মসজিদে নববী এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়। মরুভূমির দেশে এমন স্বস্তির বৃষ্টির দৃশ্য ছিল অনেকটা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির চিরায়ত রূপের মতো।
ছয় দিনের মাথায় প্রিয় নবী ও তার শহর ছেড়ে মক্কার পথে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। মদিনা থেকে আধঘণ্টা যাত্রার পরই মিকাতে গাড়ি থামল। ‘যুলহুলাইফা বা আবারে আলী’ এটি মদিনাবাসীর মিকাত হিসেবে পরিচিত। মক্কা থেকে ৩৩৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হাজারো নারী-পুরুষ সেখানে গোসল, অজু সেরে ইহরাম বাঁধেন। এখান থেকে নবীজী ইহরাম বেঁধে মক্কায় হজ করতে গিয়েছেন। মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব ৪২৩ কিলোমিটার বা ২৬২.৮৪ মাইল। দূরত্ব বেশি মনে হলেও চার লেনবিশিষ্ট একমুখী সড়কে বাসে বসলে মনে হবে আপনি বিমানে আছেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে মক্কায় পৌঁছতে। বিশাল বিশাল সড়ক, ওভারব্রিজ। জনমানবহীন বিশাল বিশাল প্রান্তর। রাস্তার দুই পাশে বিশাল বিশাল পাহাড় আর মরু প্রান্তর। যে দিকে তাকাবেন শুধু সীমাহীন মরুভূমি। বালু আর বালু। দু-চারটি ঘাসজাতীয় ছোট গুল্মজাতীয় গাছ, সারি সারি লাগানো কিছু খেজুরগাছ। মদিনা থেকে মক্কা আরো ঘণ্টাখানেকের পথ বাকি। এমন সময় পথে ইফতারের জন্য গাড়ি পার্কিং করা হলো। দেখা মিলল অপরূপ দৃশ্য।
একটু পরই নিজ চোখে দেখার সুযোগ হলো পৃথিবীর কোটি কোটি মসজিদ ও মুসল্লিদের পবিত্র কাবা শরিফকে। আহা! আনন্দ। দয়াময় হজরত ইব্রাহিম আ:-এর স্মৃতিধন্য, আল্লাহ তার নিজের ঘরেই আমাকে আসার সুযোগ করে দিলেন। হাজার হাজার হাজীর সঙ্গে আমরা গভীর রাতে ওমরাহর উদ্দেশে পবিত্র কাবার তাওয়াফ শুরু করি। তাওয়াফ শেষে দয়াময়ের একান্ত দয়ায় হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়ার সুযোগ হয়। এরপর মোয়াল্লেমের নির্দেশনায় সম্মিলিতভাবে মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ পড়া, সাফা ও মারওয়া সাঈ করাসহ ওমরাহর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। এভাবেই ইবাদত আর নফল ওমরাহ, আল্লাহর ঘর তাওয়াফের মাধ্যমেই পবিত্র রমজানে মক্কার দিনগুলো চমৎকার কাটছিল। মক্কা-মদিনায় ঘুরেই ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রতিফলন দেখা যায় বাস্তবে। সেখানে ধনী-গরিব, জাতিতে জাতিতে নেই কোনো ভেদাভেদ। পদ-পদবি, সাদা-কালোতে নেই কোনো পার্থক্য। সবাই এক আল্লাহর বান্দা ও নবীজির উম্মত।
দয়াময়ের ইবাদত আর বন্দেন্দির ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে আসতে পারেন পবিত্র নগরীর মক্কার ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরি, মক্কার জাদুঘর, কিসওয়া কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা, জাবাল-ই-রহমত, যা আরাফাতের ময়দানের পাশেই অবস্থিত। জাবাল-ই-নূর, যেখানে বিশ্বনবী ধ্যান মগ্ন থাকতেন এবং সর্বপ্রথম কুরআন নাজিল হয়, ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানের সন্নিকটবর্তী নামিরাহ, মিনার মসজিদ আল-খায়েফ, মজদালিফা, জাবাল-ই-সাওর, হিজরতের সময় বিশ্বনবী যেখানে অবস্থান করেছিলেন। জান্নাতুল মুআল্লাহ, মক্কার বিখ্যাত কবরস্থান ও দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার যত অনুপম নিদর্শন রয়েছে তার অন্যতম পবিত্র নগরীর মক্কায় জমজম কূপ অন্যতম। আপনি দেখতে পারেন, নিজের শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার জন্য নিয়ত করে এই পানি পান করতে পারবেন।


আরো সংবাদ



premium cement