২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চাঁদের আলোয় মেঘনার জলে

-

জীবন বয়ে চলছে। জীবনকে সঙ্গে করে সময় যাপিত হচ্ছে কালের চাকায়। বয়স বাড়ছে। ফেলে আসা অতীত বয়সী হচ্ছে। কোনোটা বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়ে মারা গেছে কিংবা চাপা পড়েছে আদি যুগের ধসে পড়া দেয়ালের ভেতর। কখনো বাড়ন্ত বয়সী স্মৃতিরা তারুণ্য ফিরে পাওয়ার পুরো উদ্যমে জেগে ওঠে ইচ্ছামতো। রাতদিন তাড়া করে বেড়ায় স্মৃতির ফেরিওয়ালাকে। কখনো সব স্মৃতি প্রাণ নিয়ে মিছিল করে গভীর রাতের ভেতর। স্মৃতির বাহক তখন সাক্ষী হয় ঘুমন্ত পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার। খুব সূক্ষ্মভাবে শুনতে পায় রাতের আঁধারে জেগে থাকা টিকটিকির জানান দেয়ার বাঁশি। অন্তরমম শুনতে পায় গভীর রজনীতে ঝরাপাতার মর্মভেদী আর্তচিৎকার।
স্মৃতি! আহ, জীবনতাড়ানিয়া স্মৃতি! রাতজাগানিয়া স্মৃতি! কত স্মৃতি খেলা করে জীবন চাতালে। ফেলে আসা স্মৃতিরা আসে। ক্ষতবিক্ষত করে হৃদয়কে। কাঁদায় আমাকে। আঁখিযুগল ভাসায় হৃদয়ের পানিতে। স্মৃতির প্যাভিলিয়নে হাত বাড়ালে মুঠো ভরে আসে স্মৃতিবিস্মৃতির স্তূপ। কতরকম স্মৃতিরা আসে আমাদের জীবনে। তার স্বাদ রঙ সবই আলাদা। কত রঙের স্মৃতি। কত ঘটনার সাক্ষী সাধের এ স্মৃতি। স্মৃতির অসমাপ্ত ঘুণে ধরা ডায়েরিটা হাতে নিলে নাকে গন্ধ লাগে নানান জীবনের। সময়কে ধারণ করে স্মৃতিরা তখন জেগে ওঠে। ফেলে আসা জীবনের ঈদস্মৃতিরা আমাকে বড় বেশি উতলা করে তোলে। আমার চলমান জীবনকে সুপার গ্লু আঠার মতো আটকে রাখে। জীবনকে করে তোলে বিপন্ন বিস্ময়। চলে যেতে দিব্যি ইচ্ছে হয় সোনালি সেই জীবনে।
তখন আমরা ১৭-১৮ বছরের জীবন নিয়ে পৃথিবীর শহরে রাজ্য নির্মাণ করে নিজেদের আচ্ছামতো ঘুরছি। পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ আমাদের অনুকূলে। ধরাবাঁধাহীন জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছি। জবাবদিহিতার কোনো মামলা-মোকদ্দমা নেই। সে সময় আমাদের জীবনে ঈদ আসত ভিন্নভাবে। নানা রকম আমেজে। বন্যার পানির মতো আনন্দ বয়ে আসত জীবন করিডোরে। সেবারে যখন ঈদরাতে আমরা বন্ধুরা মিলে একসাথে বের হয়েছিলাম। এটা ছিল আমাদের অদ্য জীবনের মিলিত হওয়ার শেষ রাত। তারপর আর কোনো ঈদের দুধেলা আলোর রাতে আমরা বন্ধুরা; বাসর সাজাতে পারেনি। আজ যখন বছর শেষে নিয়মের ধারাবাহিকতায় ঈদ ফিরে আসে, তখন ব্যথিত মনটা হাতড়ে বেড়াই সেই দিনগুলোকে। সেই চাঁদের ভেতর ডুব দেয়া দুপুর রাতকে।
মনে পড়ে, ঈদের দিন রাত। সব বন্ধুরা মিলে আরিজ দাদার ডিঙি নৌকা নিয়ে বের হলাম। আমাদের গ্রামের সামনে একটু দূরে নদীর মাঝামাঝি গিয়ে নৌকা ছেড়ে দিলাম। জীবন-যৌবনের গল্পে মেতে উঠলাম। রূপকথার দেশে কল্পনার মোনালিসাকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে মৃদু ঢেউয়ের নদীতে ঝড় তুললাম। আবহমান বাংলার সঙ্গীতের তালে তালে মেঘনাকে জাগিয়ে রাখলাম। বাতাসে সাঁতরে বেড়াতে লাগল আমাদের প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ এবং গানের কলি। আকাশে তখন ভাসছে ধবধবে সাদা একফালি চাঁদ। চাঁদের দুধেল আলোয় ¯œাত পৃথিবী শহরের অলিগলি। জ্যোৎস্নার ভেতর নদীর তরঙ্গে দুলছে আমাদের ডিঙি। গগন মাজারের শুক্ল মেঘ যেন নদী সম্ভোগে ভাসছে। চাঁদ কান্তির নৌকা গলিয়ে গ্রামের কোল ঘেঁষে ঘুরে বেড়াই। বৈঠার ওঠানামায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দের সাথে সাদা মুক্তা ঝরে। নদীর মৃদু ঢেউয়ের সাথে মিতালি করে লুকোচুরি খেলা করে একফালি চাঁদ। আমরা দুপুর রাত নাগাদ গল্প আড্ডায় নদীতে বেঁচে থাকি। আবার ফিরে আসি আপন নিড়ে। আজ ঈদের রাত আসে। গরুর ওলানের মতো সাদা চাঁদ ফোটে গগন মাজারে। জ্যোৎস্নার মাতামাতিতে পৃথিবী অবগাহনে পবিত্র হয়। একটি ডিঙি নৌকা পড়ে থাকে দুরন্ত স্বপ্নবাজ তরুণদের প্রতীক্ষায়। কিন্তু তারা ফিরে আসে না। তারা আবার মিলিত হয়ে নদী সম্ভোগে যাওয়ার ফুরসৎ পায় না। তারা কাঁদে। আবার কাঁদে। স্মৃতির চিরুণি তাদের হৃদয়কে ফালি ফালি করে।
ঈদের রাত সকাল হয়। সূর্যের সাথে সাথে স্মৃতিরা দলা পাকিয়ে ভিড় করে জীবনের পান্থশালায়। সব স্মৃতির অপ্রত্যাশিত আগমনে উদাসপাখির মতো দূরে শূন্যে তাকিয়ে থাকি। ঈদ প্রাতে সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। মা কাজে ব্যস্ত। আমাকে গোসল দিতে হবে একাকী। মা গোসল করিয়ে দেবেন না। শুধু বলে গেলেন। অথচ এমন ঈদের দিনে তিনি পরম যতেœ নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিতেন। লোশন, পাউডার আতর মেখে নিজ হাতে আদরে আদরে কাপড় পরিয়ে দিতেন। পকেটে গুঁজে দিতেন অনেক চকচকে নতুন নোট। মাকে সালাম করে আনন্দে আনন্দে বাবার হাত ধরে ভাইয়েরা মিলে মাঠে যেতাম। বাবার দুই হাতে আমরা ভাইয়েরা ধরতাম এবং নেচে নেচে মহানন্দে মাঠে প্রবেশ করতাম। তখন দেখতাম, গ্রামের মানুষেরা হাত তুলে বাবাকে সালাম করছে। কুশল বিনিময় করছে। সামনে এগিয়ে যেতে বলছে। আমাদের মাথায় হাত রাখছে। টোল পড়া গালে আদর দিচ্ছে।
আমাদের গর্ব হতো। আজো হয়। আরো বেশি হয়। এমন বাবা জগতে কার আছে? কিন্তু আজ ঈদ আসে-ঈদ যায়। তখন দুঃখরা বড় ব্যথা দেয় আমায়। মা এখন আর আগের মতো সাজিয়ে দেয় না। চকচকে নোট গুজে দেয় না। আজ কতটা ঈদ চলে গেছেÑ বাবার হাত ধরে মাঠে যাওয়া হয় না। বাবা বছরে কোরবানি ঈদ দেশে করেন। তখন আমাদের ঈদ পৃথিবীর অন্য সবার চেয়ে ভালো কাটে। আনন্দে বেশামাল থাকি। বাবার পেছনে পেছনে হেঁটে যাই। এখন আর কেন জানি আঙুল ধরতে পারি না। জানি না কেন? তবে এসব কি বয়সের বেড়াজাল কি না আল্লাহ ভালো জানেন! যে ঈদে বাবা থাকেন না সে ঈদে বড্ড মিস করি প্রিয় মানুষটাকে। ফোনে ধরা গলায় কথা হয় পিতা-পুত্রের। বাব আসবার প্রতীক্ষায় থাকি।
বাড়ন্ত বয়স ও জীবনের ব্যস্ততা আমাদের যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিয়েছে শৈশব কৈশোরের উৎসবমুখর জীবন থেকে। ঈদ আনন্দ যেন মহাকাশ ছাড়িয়ে হারানোর দেশে চলে গেছে। আগেকার আনন্দফুর্তি আজ শুধু জমাকৃত বেদনার ডায়েরি। ছোট ভাইবোনদের ঈদ আনন্দে দেখলে ইচ্ছে হয় ফিরে যেতে সেই দিনে। আবার নেচে উঠতে আপন ভালোবাসায়। আবার মায়ের বাড়তি আদর ও বাবার আঙুলে ধরে ঈদে যাবার সেই যাপিত দিনে ফিরে যেতে অধীর থাকে বিষণœ মন। ফিরে এসো শৈশব। ফিরে এসো ভালোবাসার স্মৃতিরা।

 


আরো সংবাদ



premium cement
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি : মিশা সভাপতি, ডিপজল সম্পাদক ফিলিপাইনে ব্রহ্মস পাঠাল ভারত, ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি চীনের মোকাবেলায় নতুন ডিভিশন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে! আবারো চেন্নাইয়ের হার, ম্লান মোস্তাফিজ 'কেএনএফ' সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা অর্থনীতিতে চুরি : ব্যাংকে ডাকাতি পাকিস্তানে আফগান তালেবান আলেম নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না করলে এ বছরই রাশিয়ার কাছে হারতে পারে ইউক্রেন : সিআইএ প্রধান রাশিয়ার সামরিক শিল্পক্ষেত্রে প্রধান যোগানদার চীন : ব্লিংকন ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে 'বিকট বিস্ফোরণ' শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সকল