২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যদি কেউ কথা না কয়

-

ঈদের দিন দুপুরে আমাদের ১৪ ইঞ্চি সাদা-কালো টিভিতে আমি আর বড়দা যখন ঈদের অনুষ্ঠান দেখছি, হেনাবুবু কোথা থেকে দৌড়ে এসে বিচলিত গলায় বলল, ‘এই মেহমান আসছে, মেহমান আসছে। তোরা সরে পড়। আমি ঘরদোর সাজাব।’ বড়দা বলল, ‘কে আসছেরে?’ ঝড়ের বেগে হেনাবুবু বলল, ‘আমার ফেসবুকের একদল বান্ধবী। একটু আগে মেসেজ করে জানিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে। কী করি কী করি!’ বড়দা শান্ত সুরে বলল, ‘তা আসলে আসুক। এত অস্থির হচ্ছিস কেন?’ মুখ বেজার করে হেনাবুবু বলল, ‘ওদের কী খেতে দেবো, ঘরে যে কিছুই নেই। তুই বাজারে গিয়ে কিছু নিয়ে আসবি?’ বড়দা হেনা বুবুকে নিরাশ করে বলল, ‘আমার কাছে যে টাকা নেই।’
টাকা কবেই বা ছিল আমাদের! বাবার মৃত্যুর পর এই সংসারে সেই যে অভাব নেমে এসেছে, আজো দূর হয়নি। আমাদের রোজদিনের অভাবের কাছে বলি হতে হতে আমরা কখনো ঈদে জামা পাইনি। ঈদে আমাদের নি¤œবিত্ত ঘরে কখনো অতিথিও আসে না।
হেনাবুবুর ছবিগুলো ভালো হয়। ফেসবুকে সেসব ছবি ছাড়তেই লাইক-কমেন্টের বন্যায় দিনে দিনে তার বন্ধুর তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। ফেসবুকে যাদের সাথে হেনা বুবুর গভীর ভাব, তারা বেশ প্রভাবশালী। তাদের সাথে মেসেঞ্জারে একান্ত আড্ডা দিতে দিতে হেনাবুবুর কাছে ফেসবুকটা হয়ে ওঠে দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ। ফেসবুকের ওইসব বন্ধু প্রায়ই যখন আমাদের বাড়িতে এসে হেনাবুবুর সাথে মিট করতে চায়, হেনাবুবু সুকৌশলে তা এড়িয়ে যায়।
২.
পড়ন্ত বিকেলে একদল সুন্দরী রমণীর আগমন আমাদের বাড়িতে। এরা হেনাবুবুর ফেসবুক ফ্রেন্ড। সবাই শুধু দেখতেই ভারী সুন্দরী নয়, তাদের গায়ের ঈদের জামাগুলোও ভারী সুন্দর। মোটা অঙ্কের টাকায় কেনা, বোঝা যায়।
ফেসবুকের হেনাবুবুকে এই প্রথম দেখে সবার ভাষ্যÑ ‘তুমি ছবিতে যত সুন্দরী, বাস্তবে এত সুন্দর নও।’ মরা হাসি দিয়ে হেনাবুবু তাদের কথা শোনে যায়। সামিয়া নামে একটি মেয়ে আমাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি এখানে থাকো!’ হেনাবুবু ভারী লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েগুলো আজ ঈদের দিনে হুট করে চলে আসবে, কে ভেবেছে।
আমাদের জীর্ণ ঘরে ঢুকে হেনাবুবুর বান্ধবীরা চকিতে বসতেই বিপত্তি ঘটল। চকি ভেঙে সবাই ধপাস করে পড়ে গেল। ডালিয়া নামে একটি মেয়ে বলল, ‘এই তোমাদের সোফা নেই? সোফায় বসে যে ফেসবুকে ছবি দাও, ওগুলো কার ঘর?’ হেনাবুবু ম্লান সুরে বলল, ‘ইয়ে, ওটা আমার মামাদের ঘর।’
ভেঙে পড়া চকি থেকে উঠে সবাই দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল। হেনাবুবু সেখান থেকে সরে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ও রঞ্জু, আমি তো লজ্জায় মরে যাই। এদেরকে কী খেতে দেবো? গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনবি?’
কার ঈদের জামার কত দাম, কোন মার্কেট থেকে কিনেছে, বান্ধবীদের এসব গল্প নীরব মুখে শুনে যাচ্ছে হেনাবুবু। লামিয়া নামে একটা মেয়ে হেনাবুবুকে বলল, ‘তোমার গায়ে পুরান জামা কেন? ঈদের জামা পরোনি?’ হেনাবুবু ছোট্ট করে বলল, ‘আমি ঈদের জামা কিনিনি যে!’ মেয়েগুলো হো হো করে হেসে উঠল। ভারী লজ্জা পেল হেনাবুবু।
ডাব খাওয়ার আড্ডা বেশ জমে উঠল। যদিও প্রথমে গ্লাসভর্তি ডাবের পানি দেখে মেয়েগুলো একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হয়তো তারা মনে মনে ভেবেছে ঈদের দিনে সেমাই, পায়েস, নুডলস-জাতীয় খানাপিনার বদলে অগত্যা এই ডাবের পানি কেন! তারা তো ধনীর দুলালি, তারা কিভাবে জানবে গরিবের অতিথিপরায়ণতার নিয়মনীতি।
সন্ধ্যার আগে ওরা যখন বিদায় নেবে, হেনাবুবু বলল, ‘চা খাবে?’ সবাই এক বাক্যে চায়ের সম্মতি জানাল। দশ মিনিটের মধ্যে হেনাবুবু লাল চা বানিয়ে এনে বান্ধবীদের সামনে পরিবেশন করতেই ওরা এক ধরনের অভিযোগের সুরে বলল, ‘সে কি! লাল চা! লাল চা আমরা খাই না।’
লাল চা না খেয়েই ওরা বিদায় হলো। ঘরে দুধ থাকলে নিশ্চয়ই হেনাবুবু দুধচা বানিয়ে ওদের সামনে আনত। লাল চায়ের কাপ থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে আর হেনাবুবুর চোখের জল টপটপ করে পড়ছে। আমরা গরিব মানুষ। চায়ের জন্য বাজার থেকে দুধ কেনার ন্যূনতম পয়সা তো আমাদের নেই।
৩.
মাঝরাতে বারান্দা থেকে বড়দা আর হেনাবুবুর কথা কানে আসছে। হেনাবুবু ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। আজ যে মেয়েগুলো আমাদের বাড়িতে আসছে, তারা সবাই একে একে হেনাবুবুকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছে। লামিয়া নামের সেই মেয়েটির মেসেজ বড়দাকে পড়ে শোনাচ্ছে হেনাবুবু। লামিয়া মেসেজে লিখেছে, ‘ফেসবুকে তোমার চেহারাসুরত দেখে মনেই হয় না তোমরা অভাবী। আজ তোমাদের বাড়ি না গেলে জানাই হতো না তুমি গরিব ঘরের মেয়ে। আমরা সবাই কিন্তু উঁচু ঘরের আদরের কন্যা। তোমাকে আমাদের সাথে মানায় না। তাই তোমাকে আমরা আমাদের ফ্রেন্ড লিস্টে রাখতে পারছি না। ভালো থেকো।’
মেসেজ পড়ে হেনাবুবু অঘোরে কাঁদতে লাগল। পাশে বসে বড়দা সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘মন খারাপ করিস না। ওরা ওদের লেভেলের। একদিন আমাদেরও সব হবে। দেখিস কিন্তু। আনন্দ উল্লাসের ঈদ একদিন আমাদেরও আসবে। আমরাও দামি জামা গায়ে দিয়ে ঈদ কাটাবো। মনে রাখিস।’ হেনাবুবুর কান্না থামছে না। বড়দা হেনাবুবুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘গান শুনবি? তবে শোনÑআমার হাড় কালা করলামরে...।’ অবাক করা সুরে বড়দা গাইতে লাগল। আজ জোছনার রাত। ঝিকিমিকি চাঁদের আলোতে ভেসে যাচ্ছে আমাদের ছোট্ট উঠোন। উঠোনে পোষা কুকুরটি লেজ নাড়ছে। গভীর জোছনায় আর বড়দার গানের সুরে মেতে উঠলÑ এই রুপালি রাত।
আমিশাপাড়া, রাজু ফার্মেসি, নোয়াখালী

 


আরো সংবাদ



premium cement