২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈদ সেলামির নতুন টাকা

-

নানা-নানীর খুবই আদরের মেয়ে আমার মা। আমার মাকে ছাড়া নানা-নানী কিছুই ভাবতে পারেন না। একটু স্পেশাল কিছু হলেই মাকে কাছে নিয়ে যেতেন। এখনো তাই। সেই সুবাদে ছোটবেলায় ঈদ করতে হতো মামাবাড়িতে। আমার মোটেও ভালো লাগত না এই বিষয়টা কেননা সারা বছর এক জায়গার মানুষের সাথে থেকে ঈদের দিনে অন্য গ্রামের মানুষের সাথে ঈদ করতে আমার কষ্ট হতো। চাচাতো ভাই-বোনেরা সবাই ঈদের দিনের আগে থেকেই নানা বিষয় পরিকল্পনা করত। ঈদের দিন এটা করতে ওটা করবে। মজার মজার খেলা করবে। আর আমি চুপ মেরে শুনতাম। কেননা আমি জানতাম যে আমার থাকা হবে না। খুব খারাপ লাগত। তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগত যখন ঈদের পরে বাড়িতে এসে চাচাতো ভাই বোনদের সাথে খেলা করতাম তখন ওরা নিজেরা ঈদের দিনে করা বিভিন্ন কাজের মজার মজার গল্প করত। আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। মন চাইত কবে যে নিজেদের বাড়ি থেকে ঈদ করতে পারব। তখন ঈদ এলে সবার মাঝে আনন্দের দেখা মিললেও আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগত। কেননা ঈদ মানেই মামাবাড়ি গিয়ে ঈদ করা। সবাইকে ছেড়ে আত্মীয় বাড়ি গিয়ে ঈদ করা খুবই জঘন্য লাগত। নিরুপায় হয়ে ঈদ করতে হতো মামাবাড়িতেই। কেননা মাকে ছাড়া আমি একটা দিনও কোথাও থাকতে পারতাম না। কোনো ঈদে আগের দিন আবার কখনো কখনো ঈদের দু-তিন দিন আগেও মা আমাকে নিয়ে চলে যেতেন মামাবাড়িতে। আর আব্বু ঈদের আগের দিন রাতে গিয়ে হাজির হতেন মামাবাড়ি। আব্বু নানা-নানীর বড় জামাতা। নানা- নানীর খুবই আদরেরও। রাতে খালামণি হাতে জোরজবরদস্তি করে মেহেদি লাগিয়ে দিতেন। আর এটাওটা বলে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করতেন। আমার রাগ ভাঙাত। বড় মামা-মামী যশোরে থাকতেন। তারা আসতেন। বিকেলে মামাবাড়ির সামনে দিয়ে পাড়ার ছেলে-মেয়েরা চাঁদ দেখা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করত। মা বলতেন ওদের সাথে গিয়ে চাঁদ দেখতে। কিন্তু আমার ভালো লাগত না। আমার মনের ভেতর এক অস্বস্তি কাজ করত।
গভীর রাত পর্যন্ত মা, খালা, মামী ও নানী বিভিন্ন টুকটাক কাজ যেমন সেমাই ভাজা, বিভিন্ন মসলা কোটাবাছা করা, পোলাওর চাল, কিশমিশসহ নানা উপকরণ গোছগাছ করে রাখতেন যেগুলো ঈদের দিন সকালে রান্না করতে হবে।
সকালে ঘুম ভাঙত ঈদের সেলামি নিয়ে হৈ-হুল্লোড় শুনে। বড় মামা প্রতি ঈদে শহর থেকে টাকার নতুন কচকচে নোট নিয়ে আসতেন। দুই টাকা, পাঁচ টাকা আর দশ টাকার নতুন নোট। ব্যাংক থেকে নিয়ে আসতেন। সবাইকে দিতেন। শুধু যে বড় মামাই সেলামি দিতেন তাই নয়। নানা দিতেন, নানী দিতেন, আব্বু দিতেন। কিন্তু একমাত্র বড় মামাই দিতেন নতুন টাকার নোট। তাইতো অন্য সবার দেয়া পুরনো নোট পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে উঠতাম। আর বারবার গুনতে থাকতাম নিজের টাকা। তারপর গোসল সেরে সবার সাথে নতুন জামা পরে ঈদগাহে যেতাম। নানার সাথে আব্বুর সাথে ঈদের নামাজ পড়ে, ঈদের মাঠ থেকে আব্বু কিছু খেলনা কিনে দিতেন সেগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। খেলনা পিস্তল, বাঁশিওয়ালা বেলুন, কটকটি গাড়ি আর কিছু কাচের বল ঈদের মাঠ থেকে কিনতে মিস হতো না কখনো। আর ওগুলো নিয়ে মামাবাড়ি ফিরে নাড়াচাড়া করতে করতে কেটেই যেত দু-তিন দিন। পরে বাড়ি ফিরে আসতাম। ঈদের আমেজ তখন শেষ। বাড়ি এসে পাড়ার সবার সাথে মেলামেশা করতাম। বিভিন্ন খেলা করতাম কিন্তু অনেক দিন ওদের এই ঈদের বিভিন্ন গল্পের নিষ্ক্রিয় শ্রোতা হয়ে আমি শুধু শুনতাম। ঈদের দিন ওরা এটা করেছে ওটা করেছে। আর এগুলো আমার খুব খারাপ লাগত। নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হতো। এখন আমি বড় হয়েছি। মাও আর ঈদের আগে যান না মামাবাড়ি। আমরা এখন নিজেদের বাড়িতে ঈদ করি। সবার সাথে এক সাথে ঈদের মজা ভাগাভাগি করে নিলেও ছোট্টবেলার ঈদে বড় মামার দেয়া সেই নতুন টাকার নোট দিয়ে ঈদের সেলামি দেয়ার মজাটা আর পাই না। এক ঈদের নতুন টাকার নোট পরের বছরের ঈদ পর্যন্ত জমিয়ে রাখা আর নতুন টাকায় ভাঁজ পড়তে না দেয়া ঈদের স্মৃতি এখনো আটকে রয়েছে আমার স্মৃতির পাতায়।
শালিখা, মাগুরা


আরো সংবাদ



premium cement