২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লাল পাঞ্জাবি

-

তখন বয়স কত হবে, ঠিক মনে নেই। পড়ি সম্ভবত ক্লাস ফোরে বা ফাইভে। আমরা বন্ধুরা ঠিক করলাম এবার ঈদে আমরা সবাই স্বপ্নপুরী ঘুরতে যাবো। সবাই লাল পাঞ্জাবি পরব। লাল পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াব। আমরা সবাই বাড়িতে বললাম সেই কথা। সবার বাবা-মা লাল পাঞ্জাবি কিনে দিলো। ব্যতিক্রম শুধু আমার বাবা। বাবা আমাকে পাঞ্জাবি কিনে দিলো না। কেন বাবা সেদিন আমাকে পাঞ্জাবি কিনে দেয়নি, সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ ঠিকই বুঝতে পারি। তখনকার দিনে মানুষের এত টাকা পয়সা ছিল না। মানুষ বাস করত দারিদ্র্যসীমার নিচে। অভাব ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। ঈদে নতুন কাপড় কেনা তো দূরের কথা সেমাই চিনি কেনার মতো টাকা ছিল না। ধার-দেনা করে সেমাই চিনি কিনত। অথবা বাড়ির বউঝিরা চালের আটা গুঁড়া করে মোটা মোটা সেমাই বানাত। সেই সেমাই রোদে শুকিয়ে ঈদের দিন গুড় দিয়ে রান্না করত। চিনির দাম বেশি বলে চিনি কিনতে পারত না। গুড় দিয়েই সেমাই রান্না করত। সেই দিনে ঈদে নতুন কাপড়চোপড় কেনা ছিল স্বপ্নের মতো। আমাদের বাড়ির পাশে ওপাড়ায় চৌধুরীরা বাস করত। ঈদের সময় শুধু তাদের ছেলেমেয়েরাই নতুন জামা কিনত। আমরা এপাড়া থেকে দলবেঁধে ওপাড়ায় যেতাম। তাদের নতুন জামাকাপড় দেখতাম। তখন নতুন জামাকাপড় দেখাটাই যেন ছিল ঈদের সবচেয়ে বড় আনন্দের!
আমার বাবা ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। জায়গাজমি ভালো থাকলেও চাষাবাদ ভালো হতো না। এখনকার মতো তখন আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি চাষ হতো না। ফলে যা আবাদ ঘরে আসত তা দিয়ে পুরো বছরের ভাত চলত না। টেনেটুনে ছয় মাস চলত। বাকি ছয় মাস ধারদেনা করে কিনে খেতে হতো। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন। ধারদেনা করে চাল কিনতে বাবা হাঁপিয়ে যেতেন। এর ওপর তো বই-খাতা-কলম কেনা আছেই।
দুই দিন পরেই ঈদ। বাবা এখনো আমাকে লাল পাঞ্জাবি কিনে দিলো না। রাগে ক্ষোভে আমি রাতে ভাত খেলাম না। বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। সারা রাত কাঁদলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা বাসায় নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারে না। রাতে দেখি বাবা হাতে নতুন লাল পাঞ্জাবি নিয়ে হাজির। লাল পাঞ্জাবি দেখে আমার সে কী আনন্দ! খুশিতে চোখ চকচক করে উঠল। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে দু’গালে এত্তগুলো চুমু খেলাম।
বললাম, তুমি আমার খুব ভালো বাবা।
ঈদের দিন সব বন্ধুরা নতুন লাল পাঞ্জাবি পরে স্বপ্নপুরী ঘুরতে গেলাম। অনেক আনন্দ করলাম। মজা করলাম। হইহুল্লোড় করলাম।
ঈদের কয়েক দিন পর জানতে পারলাম বাবা আমার নতুন পাঞ্জাবির টাকা জোগাড় করতে না পেরে অনেক দূরে গিয়ে অন্যের বাড়িতে কামলা দিয়েছেন। কামলার টাকা দিয়ে নতুন পাঞ্জাবি কিনেছেন।
আজ বাবা নেই। চলে গেছেন ওপাড়ে। না ফেরার দেশে। কিন্তু বাবার দেয়া সেই লাল পাঞ্জাবিটা আজও অক্ষত আছে আমার কাছে। রেখে দিয়েছি খুব যতœ করে। প্রতি ঈদে বের করি। দেখি, গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরি বুকে আর গালে। মনে পড়ে বাবাকে। আর তখনই চোখ ফেটে বেরিয়ে পড়ে তপ্ত অশ্রুধারা।
সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর


আরো সংবাদ



premium cement