১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্গম চরাঞ্চলে শিশুদের বিদ্যালয়

-

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল। নদীভাঙন, অভাব-দারিদ্র্য যেখানে নিত্যসঙ্গী। বৈরী প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এখানকার শিশুরা বঞ্চিত শিক্ষার আলো থেকে। দু’বেলা যেখানে পেট পুরে খেতে পায় না শিশুরা। বন্যা ও নদীভাঙনে যেখানে বাসস্থানই অনিশ্চিত, সেখানে স্কুল আসবে কোত্থেকে? আর সেই স্কুলের শিক্ষকই বা হবেন কারা?
জীবনধারণের অন্য সব সমস্যার সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রেও চরম সঙ্কট এখানে। চরাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না। আর এর ফলে ওদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এই শিশুদের আলোর পথ দেখিয়েছেন একজন মহৎ ব্যক্তি, নাম তার আশরাফ হোসাইন চৌধুরী।
আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে নিজস্ব অর্থায়নে একটি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। নিজের সুখের চিন্তা না করে সারাজীবনের কষ্টে অর্জিত অবসরকালীন ভাতার টাকায় নিজ এলাকার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে গড়ে তোলেন একটি বিদ্যালয়। পৈতৃক জায়গায় দাদার নামে ‘কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখন পিছিয়ে পড়া চরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষার বাতিঘর।
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে গঙ্গাধরদি গ্রামে বাড়ি আশরাফ হোসেন চৌধুরী (রবিন)। হরিরামপুর উপজেলা থেকে নৌকায় পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে হেঁটে কিংবা শুকনা মওসুমে ঘোড়ার গাড়িতে পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গঙ্গাধরদি গ্রামে যেতে হয়। বাপ-দাদার চরাঞ্চলে অনেক জমিজমা রয়েছে। ছোট বেলা থেকেই মাতৃভূমির প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা। তাই সেনাবাহিনীর অডিড শাখায় কর্মজীবন শেষ করে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। তার বাপ-দাদার পৈতৃক ভিটায়। প্রতি বছর নদীভাঙন, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে চরাঞ্চলের মানুষ কোনো মতে বেঁচে থাকে।
যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিভিন্ন বিষয়ে পিছিয়ে আছে চরাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। চরাঞ্চলের এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন করার জন্য কাজ শুরু করে তিনি। নিজের সুখের চিন্তা না করে তার সারা জীবনের কষ্টে অর্জিত অবসরকালীন ভাতার টাকা দিয়ে এলাকার শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য ১ জানুয়ারি ২০১২ সালে নিজের পৈতৃক জায়গায় ১৫ হাত একটি চার চালা ঘর দিয়ে তার দাদার নামে ‘কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ গড়ে তোলেন। স্কুলটি প্রতিষ্ঠালগ্নে বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন বিচারপতি নুরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আহম্মেদ হোসেন (পিন্টু)। পাশের নটাখোলা গ্রামের আবদুল ছালাম নামে একজন শিক্ষক নিয়ে স্কুল কার্যক্রম শুরু করেন। আশরাফ হোসেন চৌধুরী নিজে চরে অবস্থান করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়মিত দেখাশুনা করতেন। দিন যায় আস্তে আস্তে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে স্কুলের নিচু জায়গা মাটি ভরাট করে জায়গা সম্প্রসারণ করে চার পাশে ইটের দেয়াল দিয়ে বেড়া দেয়। লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের নটাখোলা গ্রামে যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে একটি মনোরম পরিবেশে গড়ে তুলেছেন এই স্কুলটি।
বর্তমানে কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। বিদ্যালয়টিতে গঙ্গাধরদি, বালিয়াচর, হরিহরদিয়া, নটাখোলা ও পাটগ্রামচর গ্রামের ২২৫ জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত রয়েছে। সরকারি নিয়মে সকাল ৯টা থেকে ৪টা ১৫ পর্যন্ত ক্লাস চলমান থাকে। ১ ঘণ্টা দুপুরে বিরতি রয়েছে। পাঁচজন শিক্ষক এর মাধ্যমে নিয়মিত পাঠদান করে আসছে। স্কুলটিতে পাঁচটি ক্লাসরুম, একটি শিক্ষকদের রুম এবং অতিথিদের জন্য আবাসিক রুম ও একটি স্টোর রুম রয়েছে। একটি টিউবওয়েল এবং ছেলে ও মেয়েদের জন্য রয়েছে আলাদা দু’টি টয়লেট। স্কুলটির পেছনে রয়েছে একটি পুকুর ছাত্রদের সাঁতার শেখানোর বিষয়টি মাথায় রেখে পুকুরটি তৈরি করেছেন। স্কুলের বাউন্ডারির ভেতরে এবং চার পাশে রয়েছে আম, কাঁঠাল, জলপাই, চালতা, পিয়ারাসহ নানা ফলমূলের গাছ। ২০১৪ সালে বন্ধু সভা, উল্টরণ এবং বারসিক ২০০ ফলদ গাছের চারা দিয়ে সহযোগিতা করেন।
২০১৬ সালে আমেনা আক্তার নামে এক ছাত্রী কেন্দ্র প্রথম হয় এবং এ পর্যন্ত ছয়জন ছাত্র স্কুলটি থেকে বৃত্তি পেয়েছে। বার্ষিক সমাপনী অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, বিভিন্ন সরকারি দিবস, উৎসব পালন করে থাকেন। কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক স্কুলে পাঁচজন শিক্ষকের ৬৭০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত শিক্ষকদের সম্মানী ভাতা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া শিক্ষকের ঈদ উৎসব ভাতা দেয়া হয়। স্কুলের অতিথি আপ্যায়ন ও অন্যান্য খরচের জন্য প্রতি মাসে ১০০০ টাকা করে দেন। গঙ্গাধরদি গ্রামের ছাত্র অভিভাবক মো: সোরহাব উদ্দিন বলেন, কুটি মিয়ার স্কুলের শিক্ষকেরা নিজ এলাকার হওয়ার কারণে স্কুলে সময় বেশি দেয়। ফলে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ভালো হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো: আবদুস ছালাম বলেন, আমরা সামান্য সম্মানী ভাতা নিয়ে শিক্ষকতা করি, যাতে চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। এ ছাড়া স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে অভিভাবকদের তাগিদ দিতে হবে।
স্কুলের সমস্যা বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, আরো একটি ক্লাসরুম বৃদ্ধি করা দরকার। শ্রেণী কক্ষে কয়েক জোড়া বেঞ্চ এবং অফিসিয়াল কাগজপত্র রাখার জন্য একটি আলমিরা প্রয়োজন।
কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফ হোসেন চৌধুরীর সাথে কথা বলে জানা যায়। স্কুলের উন্নয়ন ও ভবিষ্যতে তার কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, আমার এখন অনেক বয়স হয়েছে। নিজ অর্থ ব্যয়ে স্কুলটি পরিচালনা করা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। যদি স্কুলটি সরকারীকরণ করা হলে তাহলে বিদ্যালয়টি থেকে হাজারো আলোর প্রদীপ জ্বলবে। এ ছাড়া এই বিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়ে আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করবে। দেশ সেবার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে। আবার কেউ নিজ এলাকায় ফিরে এসে বাড়িতে ভাত খেয়ে শিক্ষকতা করবে, কেউ অন্যান্য চাকরি ও সেবামূলক কাজ করবে। ভবিষ্যতে তিনি স্কুলটি কম্পিউটারের মাধ্যমে ডিজিটাল শিক্ষার আওতায় যুক্ত করতে চান। হরিরামপুর উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার নায়েব আলী বলেন, লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের গঙ্গাধরদি গ্রামে কুটি মিয়া স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কাগজপত্র জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সরকারীকরণের জন্য স্কুলটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শিক্ষানুরাগী আশরাফ হোসেন চৌধুরীর এই মহতী উদ্যোগ চরাঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে চরে ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে শিক্ষার আলো, থাকবে না যৌতুক, বাল্যবিয়ে, তরুণেরা গড়বে মাদকমুক্তসমাজ, আলোকিত হবে সমাজ, গড়ে উঠবে সুন্দর বাংলাদেশ। চরবাসীর এটাই প্রত্যাশা।


আরো সংবাদ



premium cement