২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাঞ্জাবের পথে পথে ভ্রমণ

পাঞ্জাবের অম্রিতসরে গোল্ডেন টেম্পল -

শিখদের রীতিনীতি, চলাফেরা ও পোশাক-পরিচ্ছদ কাছ থেকে দেখার আগ্রহ ছিল বহু দিন ধরে। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা সত্ত্বেও সময় করে আমরা পাঁচ বন্ধু যাত্রা করলাম শিখদের দেশ পাঞ্জাব ভ্রমণে। মাঝপথে শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল, পড়লাম মহা বিপাকে। কখন ট্রেন ছাড়বে জানা নেই কারো। এ সময়টা স্টেশনে বসেই কাটাতে হলো। সন্ধ্যায় ছাড়ল ট্রেন। রাত ৮টা নাগাদ পৌঁছলাম পাঞ্জাবের রাজধানী অমৃতসরে। অটোরিকশা নিয়ে রওনা হলাম গোল্ডেন টেম্পলের দিকে।
শহরজুড়ে মাথায় পাগড়ি আর পরনে পাঞ্জাবি লোকদের বিচরণ। মুখে ঝুলছে লম্বা দাড়ি। মুসলিম মনে হলেও এরা শিখ। গোল্ডেন টেম্পলের কাছে নেমে সামনে এগোতে থাকলাম আমরা। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি রঙিন ইমারত। কয়েক স্থানে বড় পর্দায় দেখানো হচ্ছে শিখদের ইবাদতের দৃশ্য। রাস্তার মোড়ে মোড়ে নির্মিত হয়েছে ঘোড়ার বিশাল ভাস্কর্য।
থাকার ভালো হোটেল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একজন শিখ এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করলেন। হোটেলে উঠে গোসল ও বিশ্রাম করে নিলাম। শিখদের নোঙরখানায় রাতের খাবার খেয়ে গোল্ডেন টেম্পল ঘুরে দেখতে বের হলাম।
টেম্পলে প্রবেশ করতে হলে হলুদ কাপড়ের টুকরো দিয়ে মাথা ঢেকে নিতে হয়। আমরাও বেঁধে নিলাম হলুদ কাপড়। প্রধান গেট পেরোতেই টেম্পলের সোনালি রঙের ঝলক এসে পড়ল দু’চোখে। তিন দিকে পানিবেষ্টিত টেম্পলের সৌন্দর্য অপূর্ব। দিনের থেকে রাতে এর সৌন্দর্য বেশি থাকে বিধায় দর্শকের সংখ্যাও দ্বিগুণ থাকে রাতে। মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে পানিতে ভাসা টেম্পলের প্রতিবিম্ব। আলো-আঁধারিতে ঢাকা চারপাশের প্রকৃতি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সেসব দেখে পার করছিলাম একেকটা প্রহর।
গোল্ডেন টেম্পল বা স্বর্ণমন্দিরের এ জায়গাটুকু শিখদের পূজা-আর্চনার জন্য দান করেছিলেন সম্রাট আকরব। এটি নির্মাণ করেন শিখদের পঞ্চম গুরু অর্জন দেব। ১৫৮৮ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৬০৪ সালে। এটি শিখদের ধর্মগ্রন্থ ‘গুরুগ্রন্থ সাহেবের’ স্থাপনার সাথে সম্পন্ন হয়েছিল। তথ্যগুলো জানালেন মন্দিরের একজন স্থানীয় পুরোহিত।
পুকুরে নেমে গোসল করছেন কিছু শিখ আর তাদের ছেলেমেয়ে। তাদের বিশ্বাস মতে এখানে গোসল করলে অনেক পুণ্য মিলে ও অপরাধ মার্জন হয়। পুকুরের জলে সাঁতার কাটছে সোনালি রঙের কিছু মাছ। হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেখা যায়।
টেম্পলের অভ্যন্তরে শিখদের ধর্মগুরুর সমাধি। সেটা জিয়ারত করতে শিখদের লেগে আছে লম্বা লাইন। ভিড়ের কারণে আমরা আর এগোলাম না ওদিক। টেম্পলের আশপাশটা ঘুরে ও এর দৃশ্যপট ক্যামেরাবন্দী করে ফিরে এলাম হোটেলে।
পরদিন সকালে একটু দেরি করেই ওঠলাম ঘুম থেকে। পাকিস্তানের বর্ডার কাছেই। সেখানে দু’দেশের মহড়া দেখানো হয় প্রতিদিন বিকেলে। সামনে পরীক্ষার চাপ থাকায় সোখানে যাওয়া হলো না। ফেরার সময় গোল্ডেন টেম্পলের দিনের সৌন্দর্য দেখতে আরেকবার গেলাম সেখানে। রাতে বাহারি আলোয় ঝলমল করলেও দিনে তার জৌলুশ নেই তেমন। আশপাশটা ঘুরে দেখে স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেনে চড়ে রওনা হলাম সারহিন্দের পথে।
সারহিন্দে যখন ট্রেন থামল, সূর্যটা তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। জার্নিতে সবাই ক্লান্ত। ক্লান্ত দেহ নিয়েই আমরা পা বাড়ালাম হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ: (১৫৬৩-১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মাজারে। তার আসল নাম আহমদ ফারুকি। তিনি হজরত ওমর ফারুক রা:-এর বংশধর। তিনি ছিলেন ইসলামি ইতিহাসের দ্বিতীয় মুজাদ্দিদ (ধর্মের সংস্কারক)। সম্রাট আকবরের স্বঘোষিত ধর্মের (দ্বীনে ইলাহি) তিনিই মূলোৎপাটন করেছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে অনেক কাজ করেছেন বিধায় মুসলমানরা এখনো তাকে স্মরণ করেন শ্রদ্ধাভরে।
তার মাজারের পাশে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। মাজারের আশপাশে তার কয়েকজন মুরিদের কবর। একটি কবরের নেমপ্লেটে দেখলাম মৃতব্যক্তি ছিলেন বাংলাদেশী। গর্বে তখন বুকটা ভরে উঠেছিল।
মাজারটা একটি সজ্জিত কক্ষের ভেতর। আতর-গোলাপের সুগন্ধি চারপাশে ম-ম করছে। কবরটা ঢাকা রয়েছে সবুজ চাদর দিয়ে। আশপাশটা ঘুরে আর কুরআন থেকে কয়েকটি সুরা পাঠ করে বেরিয়ে এলাম মাজার থেকে।

 


আরো সংবাদ



premium cement