২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যৌন নির্যাতন রোধে আইনের প্রয়োগ

-

দেশে ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। শিশু থেকে বয়স্ক নারী কেউ নিরাপদ নন। নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বিষয়টিই যে সামনে এসে পড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজে যখন শাসন-বারণের শৈথিল্য, মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা বাড়ে; তখন আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, নানা নেতিবাচক দিক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিপীড়ন, নির্যাতন, বিচারহীনতা, খুন, ধর্ষণ সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে দুর্বৃত্তের আস্ফালন বেড়ে যায়। ফলে সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ে।
সময়ের সাথে জীবনযাপন এবং আচার-আচরণের পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক, তবে তা সমাজের মূল ছকের মধ্যে থেকে হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের পরিবার ও সমাজের যে হাজার বছরের মূল্যবোধ, তা বৈশ্বিকভাবে প্রশংসিত এবং অনুকরণীয়। দুঃখের বিষয়, যতই দিন যাচ্ছে তা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে তলানিতে ঠেকছে। পারস্পরিক সম্মানবোধ লোপ পাচ্ছে। ধর্ষণ এবং খুনের মতো নৃশংস ও বর্বর ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেই ইঙ্গিত দেয়। এসব ঘটনার সাথে প্রধানত নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত প্রভাবশালী চক্র জড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এরাই সমাজের চালক হয়ে বসে আছে। অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তি ঘটনার প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একজন ধর্ষিতার ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি আমাদের সমাজে অনেকটাই অবমাননাকর এবং কঠিন। এমনো দেখা গেছে, ধর্ষণকারীর বিচারের পরিবর্তে ধর্ষিতাকে বিচার এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এটি সম্ভব হচ্ছে, সমাজে সামষ্টিক সুকুমারবৃত্তিসম্পন্ন বিবেকবানদের নীরবতা এবং ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ায়। তারা তাদের নিজ দায়িত্ব এবং প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন। এ ধরনের মানসিকতার কারণে অপরাধী প্রশ্রয় পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
ধর্ষণকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ জোর করে বিয়ের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনাটি এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে। অথবা পরিবার, সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করছেন ধর্ষিতা। তদুপরি তথাকথিত সামাজিক বিচারে ধর্ষকের পরিবর্তে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ধর্ষিতাকে। উৎপীড়িত পরিবারটিকে করা হচ্ছে একঘরে। কোথাও যদি ধর্ষকের শাস্তি হয়ও, তবে তা নামমাত্র। অথচ অসহায় ধর্ষিতাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় অপবাদের বোঝা। ট্র্যাজেডি হলোÑ ধর্ষণ, নিপীড়ন, যৌন নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা বেশির ভাগ সময়ই গণমাধ্যমে আসে না। পরিবারের মান-সম্মান, মেয়ের সম্ভ্রম, সামাজিকতা ও লোকলজ্জার ভয়ে তা চেপে যাওয়া হয় অথবা দেয়া হয় ধামাচাপা।
অবশ্য, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এসব অপকর্ম প্রতিরোধে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্নসহ দেশে কঠিন আইন রয়েছে। দুঃখের বিষয়, বিস্তৃত পরিসরে এর প্রয়োগ সীমিত ও সীমাবদ্ধ। এর জন্য থানা-পুলিশও কম দায়ী নয়। সেখানে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে বিস্তর। বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অভিগম্যতা সীমিত। আর সে জন্য শুধু আইন থাকলেই হবে না, এর পাশাপাশি সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টি সমাজে এখনো তেমন গুরুত্ব পায়নি। এ অবস্থায় সহিংসতার শিকার নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় অভিগম্যতা বাড়ানো না গেলে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। সরকার ও আদালত এ ক্ষেত্রে নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আন্তরিক ও সচেষ্ট হলে তা অনেকাংশে কমে আসতে পারে।
তবে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে কেবল কঠোর আইনই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় অনেক কম। অপরাধ করে পার পাওয়া যায়, এ ধরনের ধারণা থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এটি শুধু পেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে নয়, যে কারো ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে। তাই ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংস অপরাধের রাশ টেনে ধরতে প্রথম কাজ হচ্ছে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে গতি সঞ্চার করা। অপরাধ সংঘটনের সাথে সাথে অপরাধীকে গ্রেফতার করা। ধর্ষণের ঘটনার সমান্তরালে যদি শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ধর্ষণপ্রবণতা কমবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সেজন্য উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচারের উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না পেলে অপরাধীরা অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ পায়। ফলে সব ধরনের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সুশাসন তথা আইনের শাসন মজবুত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তবে ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারীর সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শুধু আইনের শাসনই যথেষ্ট নয়, সামাজিক শক্তিরও প্রবল সমর্থন প্রয়োজন। নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্ভব নয়। এ জন্য সামাজিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্ষণের প্রতি শূন্য সহনশীলতা দেখাতে হবে শুধু সরকারকে নয়, গোটা সমাজকে। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে ব্যক্তি, পরিবার, পাড়া-মহল্লাসহ সবাই সোচ্চার হতে হবে। হ
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement