২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অর্থনীতির অগ্রগতিতে বাধা যানজট

-

বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী ঢাকায় নাগরিকদের জীবনযাত্রা ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এর মধ্যে যানজটের মাত্রা অসহনীয়। রাজধানীবাসীকে প্রতিনিয়ত যানজট মোকাবেলা করে চলাফেরা করতে হয়। যানজট প্রকট আকার ধারণ করলেও প্রতিকারের ব্যবস্থা হতাশাজনক। এ নিয়ে বহু লেখালেখি ও বিভিন্ন কথা শোনা গেলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। উল্টো দিন দিন যানজটের তীব্রতা বাড়ছে। ঢাকার অসহনীয় যানজটের কারণে এই নগরীর অগণন বাসিন্দার মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তা বর্ণনাতীত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতেও যানজট নেই, তা নয়! তবে ঢাকার মতো ভয়াবহ নয়। যানজট সুপারসনিক গতিতে বাড়লেও পরিত্রাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে কচ্ছপগতিতে।
যারা বিএমডব্লিউ, ল্যান্ড ক্রুজার, মার্সিডিজির মতো নামীদামি গাড়িতে চড়ে এসির বাতাস খেয়ে রাজধানীতে চলাফেরা করেন, তাদের কথা আলাদা। গরমের সময় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাচলকারী যেকোনো যাত্রীর শরীরের জামা খুলে ফেলতে ইচ্ছে করে। যারা গণপরিবহনে যাতায়াত করেন; তারা বোঝেন যানজট কী জিনিস।
দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে যানজট। এর কারণে যে সময় নষ্ট হয়, তা অর্থনীতির বিচারে অনেক চড়ামূল্য। যানজট শুধু অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, দেশের রফতানি বাণিজ্যকে হুমকিতে ঠেলে দিচ্ছে। যানজটের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হন। নাম্বিও নামে একটি গ্লোবাল ডেটাবেইসের সমীক্ষায় ২০১৯ সালে ঢাকাকে বিশে^র সর্বাধিক যানজটের শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুই বছর আগে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়, ২০১৬ সালে ছিল তৃতীয়। সূচকের দিক থেকে কলকাতাকে টপকে গেছে ঢাকা।
কোনো সরকারই যানজটের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রাজধানীবাসীর নাগরিক সুবিধা বাড়াতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করে। কিন্তু সরকার যে প্রত্যাশায় ডিসিসি ভাগ করেছিল, তার সুফল জনগণ কতটুকু পেয়েছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভাষ্যমতে, গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৭৩ হাজার ১৬০টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৪টি। বাস ৩৯ হাজার ৭৮২টি। গত পাঁচ মাসে সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতি মাসে প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তিগত গাড়িই নিবন্ধিত হচ্ছে। তাছাড়া অনিবন্ধিত কত যানবাহন চলাচল করছে তার হিসাব কারো কাছে নেই। ঢাকা শহরের মোট সড়কের প্রায় ৫০ শতাংশজুড়েই চলাচল করে ব্যক্তিগত গাড়ি। এগুলো বহন করে ১২ শতাংশ যাত্রী। এসব কারণে যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকার যানজটের মাত্রা কতটা প্রকট তা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবির) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকায় যানজটে বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর্থিক হিসেবে এর পরিমাণ প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। যানজটের ক্ষতি পরিমাপে সময় ও জ¦ালানি তেলের অপচয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও শহরমুখী প্রবণতার বৃদ্ধি বিবেচনা করেছে এডিবি। যানজটে ব্রিটেনে জিডিপির ক্ষতি ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ফ্রান্সের ক্ষতি জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ, জার্মানিতে দশমিক ৯ ও যুক্তরাষ্ট্রে দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ^ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, গত ১০ বছরে ঢাকায় যান চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে সাত কিলোমিটারে নেমে এসেছে। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, একজন মুমূর্ষু রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে যথাসময়ে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, শুধু রাজধানীতে যানজটে মানুষের কর্মক্ষমতা ও জ্বালানি বাবদ অপচয় হয় বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় অগ্রগতির পথে বড় প্রতিবন্ধক যানজট। এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে না পারলে উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার স্বপ্ন বর্ষার পানিতে ডুবে যেতে পারে। তবে যানজটের পেছনে যতগুলো কারণ নিহিত রয়েছে; তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভিআইপিদের গাড়ি চলাচলে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি। ভিআইপিদের অগ্রাধিকার শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখা যায় কিনা তা সরকার ভেবে দেখতে পারে। এতে নগরবাসীর দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারে। যানজট নিরসনে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণের বদলে ট্রাফিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বেশি নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে রাজধানীজুড়ে ফ্লাইওভারের জাল বুনলেও কোনো কাজ হবে না। এটা ঠিক, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত ও যানজট কমানোর লক্ষ্যে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ফ্লাইওভারের কারণে এক জায়গায় যানজট কমলেও অন্য স্থানে ঠিকই জটলা বাঁধছে। এ ছাড়া অন্য কারণ হচ্ছেÑ চালকদের খেয়ালি আচরণ, ফুটপাথে দোকানপাট, যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, ছোট তথা ব্যক্তিগত গাড়ি, এলোপাতাড়ি রিকশার চলাচল। যত রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, এর কয়েক গুণ বেশি চলাচল করছে। অনুমোদিত ৮০ হাজারের পরিবর্তে কয়েক লাখ রিকশা চলাচল করছে রাজধানীতে। অন্য কোনো দেশে দ্রুত ও ধীরগতির যান চলাচলের দৃশ্য দেখা যায় না।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তকমা লেগেছে ঢাকার গায়ে। তবু স্রোতের মতো মানুষ ঢুকছে ঢাকায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিদিন আড়াই-তিন হাজার মানুষ ঢাকামুখী। সরকারি হিসাবে এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ ঢাকায় বাস করেন। ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা যোগ করলে আরো বাড়বে। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় তিন হাজার লোকের বাস। এমন ঘন বসতিপূর্ণ শহরে নাগরিকদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা খুব কঠিন একটি কাজ।
নাগরিকদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থাকলেও নগরবাসী ন্যূনতম সেবাটুকু পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি রাষ্ট্রের ভেবে দেখা উচিত। বিশেষ করে ঢাকার ওপর চাপ কমাতে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি। কোনো সরকারই তা আমলে নেয়নি। চিকিৎসা, শিক্ষা আর চাকরি সবই ঢাকায় কেন? দেশের অন্য জেলাগুলোতে উন্নয়ন তরান্বিত করতে পারলে ঢাকামুখী প্রবণতা কমে আসবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া প্রশাসনকে ডিসেন্ট্রালাইজেশন যেমন করা সম্ভব নয়, তেমনি ভোগান্তির যানজট থেকেও নগরবাসীকে মুক্তি দেয়া অসম্ভব। ঢাকার যতটুকু সড়কপথ আছে; তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে যানজট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
ফিলিপাইনে একসময় তীব্র যানজট ছিল। দেশটির জনগণের স্বাভাবিক চলাচল ছিল কষ্টসাধ্য। এখন সেখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থা বেশ উন্নত। ফিলিপাইনের মতো দেশ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে যানজট নিরসন করতে পেরেছে। শৃঙ্খলা না থাকলে শহর যতই পরিপাটি হোক না কেন, অরাজকতা দূর হবে না। নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকলে যানজট দূর হতে বাধ্য। এর উদাহারণ রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যতগুলো পথ জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত; সে পথে বাসচালক ইচ্ছে করলেই স্টপেজ ব্যতীত গাড়ি থামিয়ে লোক উঠাতে পারেন না। ফলে ক্যান্টনমেন্টে সচরাচর যানজট দেখা যায় না। তাই বলতে চাই, ঢাকার যানজট মুক্ত করতে দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা নিয়ে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে সরকার উদ্যোগী হবে, এমটিই আশা সবার। হ


আরো সংবাদ



premium cement
‘পেশাগত স্বার্থে সাংবাদিকদের ঐক্যবব্ধ হতে হবে’ গাজাবাসীর প্রধান কথা- ‘আমাদের খাবার চাই’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সকল