২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বার্লিনের পথে

-

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ ও ‘হিটলার’-এর নাম। এর সাথে যুক্ত আছে ‘জার্মানি’ নামের একটি দেশ। হঠাৎ একটা সুযোগ এসে গেল। বিশেষ করে চিটাগাং সোস্যাল বিজনেস সেন্টার লিমিটেডের একজন অংশীদার সদস্য হওয়ার সুবাধে এ ধরনের একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের আমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম। ইতঃপূর্বে ক’টি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে পারিনি পারিবারিক ও পেশাগত ব্যস্ততার কারণে। ৯ নভেম্বর ২০১৮ সন্ধ্যায় জার্মানির ওলফসবার্গ অটোস্ট্যাডে নবম গ্লোবাল সোস্যাল বিজনেস সামিট শেষ হয়েছে। ‘সেঞ্জান’ ভিসায় আরো দু’টি দেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল। একটি চেক প্রজাতন্ত্র অপরটি অস্ট্রিয়া। তবে জার্মানির রাজধানী বার্লিন না দেখে অন্য কোথাও যাবো না। বার্লিনের দেয়াল দেখার খুব শখ। ১০ নভেম্বর ট্রেনে ওলফসবার্গ থেকে জার্মানির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর বার্লিনের দিকে রওনা হলাম। একজন তুর্কি স্টুডেন্ট অবসরে ভাড়ায় ট্যাক্সি ক্যাব চালায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। আমাদের সে গাড়িটি খুবই চমৎকার বিদ্যুৎচালিত। সর্বত্র শৃঙ্খলার শহর। জননিরাপত্তার অভাব নেই, মহিলাদেরও গাড়ি চালাতে দেখেছি। জানলাম, এখানে প্রচুর বাংলাদেশী স্টুডেন্ট ও কর্মজীবীও রয়েছেন। জার্মানির দুই-তৃতীয়াংশ লোক ক্যাথলিক অথবা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান। ১০ মিনিটে শহরের মেইন স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। স্টেশনটি ঘুরে দেখলাম, ওদের প্রত্যেক রেল স্টেশন যেন এক একটি সুপার মার্কেট। ইনফরমেশন ডেস্ক থেকে সব তথ্য জানা যায়, বিরক্তিভাব নেই, সবাই হাসিমুখে ডিউটি করছেন। আমাদের টিকিট বাংলাদেশ থেকেই অনলাইন বুকিং কনফার্ম ছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়েতে গিয়ে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম খুঁজে বের করলাম। কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন আসছে, থামছে। প্যাসেঞ্জার নামছে, উঠছে; আবার ট্রেন ছুটছে। দু’তলাবিশিষ্ট ট্রেনে শত শত গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ছবি তুলতে চাইলাম। এত দ্রুত ট্রেন ছুটে চলেছে যে, ছবি তুলতে বারবার চেষ্টা করে পারলাম না, ছবি ঝাঁপসা হয়ে গেল। ট্রেন এসে গেল, নির্দিষ্ট বগিতে উঠে সিটে গিয়ে বসলাম। সিটে জার্নাল ও পত্রিকা রয়েছে। সেকেন্ড ক্লাস আর ফাস্ট ক্লাসের পার্থক্য বুঝলাম না। ট্রেনে মোবাইল চার্জ এবং ওয়াইফাই সুবিধাও পেলাম। সফরসঙ্গী আগের সম্মেলনে বার্লিন এসেছিলেন। আমার অনুরোধেই তিনি বার্লিনে দ্বিতীয়বার আসলেন, ‘বার্লিন প্রাচীর’ দেখাতে। ট্রেনে হিটার থাকায় লংকোর্ট হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলাম। নদী, পাহাড়, সমতল বন-জঙ্গল, শস্য ক্ষেত ফেলে দ্রুতগামী ট্রেন স্টেশনের পর স্টেশনে দুই-তিন মিনিট থেমে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় পাহাড় না কেটে সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ট্রেন লাইন চলে গেছে। তারা পরিবেশ সচেতন জাতি হিসেবে বিশ্বে সুপরিচিত। প্রতিটি নাগরিক বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সংক্রান্ত ব্যাপারে সচেতন। তারা ক্ষতিকর গ্যাসের অল্প নির্গমন নিশ্চিত করে। জার্মান সরকার দূষণ রোধের পদক্ষেপ নিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যকার মিত্রতা ১৯৪০ দশকের শেষে ভেঙে গেলে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তথা পূর্ব জার্মানিতে পরিণত হয়। পশ্চিমের নিয়ন্ত্রিত বাকি তিন অঞ্চল একত্রিত হয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করে। যদিও জার্মানির ঐতিহাসিক রাজধানী বার্লিন পূর্ব জার্মানির অনেক অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিল। তা সত্ত্বেও এটিকে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কিন্তু পূর্ব জার্মানির লাখ লাখ অধিবাসী অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানিতে অধিবাসী হওয়া শুরু করলে ১৯৬১ সালে সোভিয়েত মদদপুষ্ট পূর্ব জার্মানির সরকার বার্লিনে একটি প্রাচীর তুলে দেয় এবং দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করে। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের বাসিন্দারা বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলে। ঘটনাটিকে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পতন ও জার্মানির পুনঃ একত্রীকরণের প্রতীক হিসেবে গণ্য করে। আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রিত হয়ে ‘জার্মান ফেডারেল প্রজাতন্ত্র’ গঠন করে। তবে দুই জার্মানির ভিন্ন সংস্কৃতি ও রীতিনীতির মিলন একত্রিত জার্মানির সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমস্যার সৃষ্টি করে। উচ্চ বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস এর নজির।
দ্রুতগামী ট্রেনের দু’পাশে ছবির মতো ঘরবাড়ি, পাতাঝরা গাছের দৃশ্য দেখছিলাম। জার্মানিতে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৩৩ শতাংশ, স্থায়ী চারণভূমি ১৫ শতাংশ এবং বনভূমি ৩১ শতাংশ। দু’পাশে হরেক রকমের অনেক গাছ। ফ্রেঞ্চাই, পাইন, লার্চ প্রভৃতি ছাড়াও নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি। বলতে হয়, জার্মানি অত্যন্ত ব্যয়বহুল দেশ। তাই সতর্কতার সাথে চলাফেরা, হাটবাজার ইত্যাদি করতে হয়। আমরা মাত্র চার ঘণ্টায় বার্লিন মেইন স্টেশনে এসে পড়লাম।
শুরু হলো সিটি ট্যুর। এ সেই প্রিয় বার্লিন শহর, যাকে না দেখে, বর্ণনা শুনেই ভালোবেসে ফেলেছি। চারদিকে সুন্দর পরিপাটি দৃশ্য ও শৃঙ্খলা মুগ্ধ করে ফেলেছে। এ যেন পর্যটকদের শহর। নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষ ছুটে চলেছে গাড়িতে ও হেঁটে বার্লিনকে উপভোগ করতে। ঐতিহাসিক বার্লিন গেটের পাশ দিয়ে যেতেই ছবিতে তা বন্দী করলাম। একটি ঐতিহাসিক গির্জার পাশে এসে গাড়ি থামল ১০ মিনিটের জন্য। ছবি তুলতে তুলতে এসে দেখি গাড়ি নেই। আমাদের লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের আরেকজন কর্মচারী। চুরির সম্ভাবনাই নেই দেখে অবাক হলাম। পরবর্তী গাড়িতে উঠে পড়লাম। আর ইয়ার ফোনে দু’পাশের ধারাবর্ণনা শুনে যাচ্ছিলাম। জুওলজিক্যাল গার্ডেন, পাখিশালা, অ্যাকুরিয়াম, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পার্ক চিড়িয়াখানা, প্রাণী সংগ্রহশালা ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক দালান, ব্যাংক, মন্ত্রণালয় প্রভৃতি ধারাবর্ণনার সাথে মিলিয়ে দেখে যাচ্ছিলাম। ঘোড়ার গাড়ি আমাদের দেশে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তারা ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে। বিশাল ঘোড়া, লোহার বুট পরা টগবগ করে ছুটে চলেছে। মাঝে মধ্যে কিছু সুভিনিয়র, চকলেট কিনলাম। ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে জার্মানিই ইউরোপের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো চালু করেছিল। তাই সর্বত্র ইউরো চলে। জার্মানির মধ্য দিয়ে ইউরোপের অনেকগুলো প্রধান নদী যেমনÑ রাইন, দানিউর, এলবে প্রবাহিত হয়েছে এবং দেশটিকে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে সাহায্য করেছে। বার্লিনের দেয়াল ধরে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা চলে। বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানের সীমানায় একটি চেকপোস্ট ছিল। সেখানে সীমান্তরক্ষীর পোশাক পরে কিছুক্ষণ ‘ডামি ডিউটি’ করলাম। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের চমৎকার ব্যবস্থা। ইতিহাস মুছে ফেলা বা বানানো ইতিহাস চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা তাদের মধ্যে নেই। জার্মানিকে অনেকে হিটলারের দেশ মনে করলেও আসলে হিটলারের জন্ম অস্ট্রিয়ায়। হ
লেখক : আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী


আরো সংবাদ



premium cement
সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক

সকল