১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোবো গ্যাংয়ের স্বপ্ন ড্রোন তৈরি

-

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে প্রায়ই চোখে পড়বে আকাশে ড্রোন ওড়াতে ব্যস্ত একদল শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলকট্রনিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ সময় কাটে গবেষণাগারে।
দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী যখন স্বপ্ন দেখছে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে বিসিএস ক্যাডার কিংবা ভালো চাকরিজীবী হওয়ার, তখন এসব শিক্ষার্থী স্বপ্ন দেখছেন প্রযুক্তিভিত্তিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার, যে বাংলাদেশ ড্রোন আমদানি নয়, রফতানি করবে। আর এ স্বপ্ন নিয়েই ইইই বিভাগের এসব শিক্ষার্থী গঠন করেছে ‘রোবো গ্যাং’ দল। চার শিক্ষার্থীর এই ছোটো দলটি মাত্র দুই বছরে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেয়েছে। সর্বশেষ তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘রোবো কার্নিভাল-২০১৯’। এ প্রতিযোগিতায় দেশের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন তারা। রোবট নিয়ে স্বপ্ন দেখা চার সদস্যের এ ‘রোবো গ্যাং’ টিমের প্রধান উদ্যোক্তা মেহেদী হাসান। অন্য তিন সদস্যÑ ওহিদুর রহমান বাপ্পি, হাবিবুল্লাহ নিয়ন ও তানভীর আহমেদ রিমন।
এই চার তরুণের একসাথে কাজ শুরুর গল্প একটু ভিন্ন রকম। মেহেদী হাসানের বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে হবেন একজন ইসলাম ধর্ম বিশেষজ্ঞ। এ উদ্দেশ্যে ছেলেকে পড়িয়েছিলেন মাদরাসায়। কিন্তু ছেলের আগ্রহ ছিল বিজ্ঞানের প্রতি। তাই মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষে স্বপ্ন দেখেন ইলেকট্রনিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার। তবে স্বপ্নের পথে প্রথমেই বাধ সাধেন বাবা। কিন্তু মেহেদী তার অবস্থানে ছিলেন অনড়। একসময় বাবাও হার মানেন ছেলের স্বপ্নের কাছে। তবে বাবা ছেলের মান-অভিমানে প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারেননি মেহেদী। দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ পান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনি বেছে নেন বশেমুরবিপ্রবিকে।
ওয়াহিদুর রহমান বাপ্পীর স্বপ্ন ছিল কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার। আর হাবিবুল্লাহ নিয়ন ও তানভীর আহমেদ রিমনের স্বপ্ন ছিল বুয়েটে ইলেকট্রনিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগে পড়ার। কিন্তু ভাগ্য তাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছিল অন্য কিছু। সৌভাগ্যক্রমে এ চার শিক্ষার্থী হয়ে যান সহপাঠী, স্বপ্ন আলাদা থাকলেও চারজনের মধ্যে ছিল গবেষণার ইচ্ছে। আবিষ্কারের নেশা। আর স্বপ্ন ছিল প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্বজয়ের বাসনা। সেই স্বপ্নসাধ পূরণে ২০১৭ সালে গড়ে তোলেন ‘রোবো গ্যাং’। ২০১৮ সালে গঠন করেন ‘বশেমুরবিপ্রবি রোবোটিকস অ্যান্ড রিসার্চ ক্লাব’। শুরুটা সহজ ছিল না এ তরুণদের। দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তাদের বিভাগেও ব্যবহারিকের তুলনায় তাত্ত্বিক শিক্ষাতেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো; তাই অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়া এবং খারাপ ফলের ভয়ে গবেষণা বন্ধ করে দেন। তবে এই চার শিক্ষার্থী ভয়ের কাছে স্বপ্নকে হেরে যেতে দেননি। তাদের উৎসাহে বিভাগের শিক্ষকেরাও সহযোগিতা করতে শুরু করেন।
যাত্রার কয়েক মাসের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত জাতীয় সায়েন্স ফেস্ট-২০১৭-তে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘রোবো গ্যাং’ শুরু করে সাফল্য। পরবর্তীতে দলটি দ্বিতীয় রানার্সআপ হয় ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যাসোনেন্স-২০১৭’-তে। সাফল্যের ২০১৭ কাটানোর পর ২০১৮-তে প্রথমবার ব্যর্থতা হয় রোবো গ্যাং। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সময় অবতরণের স্থান নির্ধারণে ভুল হওয়ায় বিধ্বস্ত হয় তাদের ড্রোনটি। তবে ব্যর্থতা তাদের দমাতে পারেনি। নিরলস পরিশ্রমে তারা ড্রোনটির পুনর্নির্মাণ আর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করেন। এই পুনর্নির্মিত ড্রোনটি নিয়ে তারা চ্যাম্পিয়ন হন রোবো কার্নিভালে। তাদের আবিষ্কৃত ড্রোনটির সাহায্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বন্যাকবলিত বা দুর্গত পাহাড়ি এলাকায় ওধুষ ও ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ, নির্দিষ্ট এলাকা টহল দেয়াসহ ভালো রেজ্যুলেশনের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ ও সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব। এমনকি ড্রোনটি গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হয়ে ট্র্যাকিংয়ের কাজও করতে সক্ষম।
রোবো গ্যাং টিম তাদের ড্রোনের এয়ারফ্রেম তৈরি করেছে নিজস্ব প্রযুক্তিতে আকাশী গাছের কাঠ দিয়ে। প্রসেসিং ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করেছে এআরএম কর্টেক্স এম-৩ প্রসেসর। সেন্সর হিসেবে ব্যবহার করেছে এক্সিলেরোমিটার। গাইরোস্কোপ, ব্যারোমিটার ও জিপিএস সিস্টেম যা স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা। হার্ডওয়্যার পরিচালনায় ব্যবহার করেছে নিজস্ব তৈরি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার।
তাদের তৈরি ড্রোনের সমমানের ড্রোন কিনতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারে খরচ করতে হবে চার-পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু তারা ওই একই সুবিধাসম্পন ড্রোন তৈরি করেছেন ২৫ হাজার টাকায়।
আমাদের দেশে নিরাপত্তা বাহিনী যে সব ড্রোন ব্যবহার করে, তা আমদানি করা হয়। এগুলো আমদানি করা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল; তেমনি এসব ড্রোনে তথ্য সংগ্রহে ওয়ারলেস সিস্টেম ব্যবহার করায় রফতানিকারক দেশের আমাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরির আশঙ্কা থেকে যায়। যা আমাদের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ‘রোবো গ্যাং’ টিমের সদস্যদের মতে, সরকারের সহযোগিতা পেলে তাদের পক্ষে রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী স্বল্প খরচে উন্নত ড্রোন নির্মাণ সম্ভব। এতে একদিকে যেমন অর্থের অপচয় রোধ হবে; অন্য দিকে নিরাপত্তাও সুনিশ্চিত হবে। পাশাপাশি দেশের শিক্ষার্থীরাও এ ধরনের আবিষ্কার এবং গবেষণায় উৎসাহী হবে।
তবে এ জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা। এখন পর্যন্ত এ চার শিক্ষার্থী নিজেদের অর্থায়নে ড্রোন তৈরিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু অধিকতর গবেষণা আর উন্নতমানের রোবট তৈরিতে যে কাঁচামালের প্রয়োজন, তা ব্যয়বহুল হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। তাই এসব শিক্ষার্থীর আশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিগগিরই তাদের এ বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা দেবে। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।


আরো সংবাদ



premium cement