২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গোমতীর অপরূপ সৌন্দর্য

-

এক সময়ের খরস্রোতা গোমতী নদীর সেই যৌবন আর নেই। অথচ আগে প্রতি বছর গোমতীর ভাঙনে বিলীন হতো কত ঘরবাড়ি আর ফসলি জমি। বর্ষায় ভরা যৌবনা গোমতীর দুই তীরে ঢেউ খেলত আর হামাগুড়ি দিয়ে মেঘনার দিকে ছুটত। এর দাপটে দুই তীরের মানুষ থাকত ভয়ে তটস্থ। আতঙ্কে কাটত রাত-দিন। ডিঙি নৌকা ঢেউয়ের তালে তালে ছুটে চলত ভাটিতে। আর খরা মওসুমে দুই তীরের মানুষজন চরের বালিমাটিতে সবজি আবাদে ব্যস্ত দিন কাটাত। কেউ বা জাল দিয়ে মাছ ধরত। বড় বড় নৌকায় করে কুমারের দল মাটির হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে ভাটির দেশ থেকে এসে নোঙর ফেলে কৃষাণীর কাছে বিক্রি করত। রাতে রান্না সেরে ডিঙ্গিতেই ঘুমাত। কোনো কোনো ডিঙ্গিতে গানের আসর বসত।
বর্ষায় দেখা যেত গোমতীর রুদ্রমূর্তি। খরায় মায়ার ছাপ। এ দু’রূপে গোমতী ধরা দিত দুই তীরের বাসিন্দাদের কাছে। দুই তীরের বাসিন্দাদের সাথে কখনো শত্রুতা, কখনো বন্ধুত্বের সম্পর্কে গোমতীর ছিল সুখের দিনলিপি।
গোমতীর সাথে আমার রয়েছে গভীর মিতালী। সেই ছেলেবেলায় গোমতীতটে কত যে সময় ব্যয় করেছি, তার কোনো হিসাব নেই। মায়ের জন্মভূমি হওয়ায় সম্পর্কটা ছিল সুগভীর। ছুটি পেলেই ছুটে যেতাম পূর্বহুড়া গ্রামে। বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে গোসলে মেতে থাকতাম। চৈত্রে যখন পানি কমে যেত; তখন ছোট ছোট মাছ ধরার আনন্দটাই ছিল আলাদা। যা আজো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। পরবর্তীতে পরিণত বয়সে সম্পর্কটা আরো পোক্ত করেন বাবা আবদুল আজিজ। গোমতীর অপর তীরের ময়নামতি ইউনিয়নের শমেষপুর গ্রামের ফাতেমা বেগমের সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ করে। গোমতীর এক তীর আমার মায়ের জন্মভিটে। অপর পারে স্ত্রীর জন্ম ভিটা। গোমতীর সাথে তাইতো আমার সম্পর্ক সুনিবিড়।
ওই দুই গ্রামের পাশ দিয়ে গোমতীর পথচলা। তবে আগের সেই তেজ আর নেই। মনে হয় অনুভূতিহীন এক বৃদ্ধ। চোখ দু’টি জাগ্রত। মুখে নেই ভাষা। দেখতে পায় সব। অথচ বলতে পারে না কিছু। বুকে গুমড়ে মরে না বলা কথা।
ভূমিদস্যুরা প্রতিদিন গোমতীর বুকের প্রাণশক্তি লুটে ব্যতিব্যস্ত। আর বৃদ্ধ গোমতী শত দুঃখ কষ্ট নীরবে সইসে। উৎসস্থল থেকে আগের মতো জলরাশি প্রবাহিত না হওয়ায় বর্ষা ও খরা সব সময়ই থাকে মরা ভাব। যেন সব কিছু হারিয়ে এতিম অসহায়। টইটুম্বুর যৌবন এখন শুধুই স্মৃতি। গোমতীর রক্ষণাবেক্ষণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব থাকলেও তারা উদাসীন। নীরব দর্শকের ভূমিকায় তারা। অথচ সবার চোখের সামনে নদীটি মরে যাচ্ছে। সবাই কেমন নির্লিপ্ত।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যর উদয়পুরের সোনাইমুড়ি থেকে উৎপত্তি গোমতীর ৮৩ কিলোমিটারের মূল অংশ কুমিল্লায় প্রবাহিত। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কটকবাজার থেকে নদীটি কুমিল্লা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিশেছে।
এ তো হতাশার মধ্যেও আশার কথা, গোমতী অববাহিকায় পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় অপার সম্ভাবনাময় গোমতীর চর হয়ে যাচ্ছে বেদখল। নদীর উভয় তীরে এখন পিচঢালা পথ। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার ফলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে পর্যটক এসে উপভোগ করতে পারেন গোমতীর অপূর্ব সৌন্দর্য।
দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে গোমতীর দুই তীর। নদীর দুই তীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে তোলা হচ্ছে ছোট ছোট কফিশপ। চালা ছাড়া কটেজে তৈরি করা বাঁশের বেঞ্চে বসে কফি কিংবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উপভোগ করতে দেখা যায় প্রকৃতিপ্রেমীদের। শেষ বিকেলে দর্শনার্থীদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে কটেজগুলো।
রেল সেতুর নিচে বড় বড় পাথর জমে নদীর গতিপথে সামান্য বাধা হয়ে ঘূর্ণিপাক তৈরি হয়ে পানির স্রোত অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। নদীর স্রোতের ঘূর্ণিপার্ক ছোট-বড় ঢেউয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিকেলে সব বয়সী মানুষদের ভিড় বাড়তে থাকে। অনেকেই নদীর পানিতে আধো ডুবে থাকা পাথরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রসৈকতের স্বাদ নেন। মুঠোফোনের ক্যামেরায় ধারণ করেন ছবি। কামারখাড়া সেতুসংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ফাস্ট ফুডের দোকান। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে বসে জম্পেশ আড্ডা। হ
লেখক : সাংবাদিক, বুড়িচং, কুমিল্লা


আরো সংবাদ



premium cement