২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন বনাম ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন

-

আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা ও সংশয় যেন দূর করা যাচ্ছে না। আর এ জন্য দায়ী বোধ করি নির্বাচন কমিশন। তারা আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করছেন। ইসির ভাষ্য, ‘একটি বড় নির্বাচনে অনিয়ম যে হবে না এটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’ ‘বাংলাদেশে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’ বলে বিশ্বাস করেন একজন নির্বাচন কমিশনার। তারাই আবার বলছেন, আগামী নির্বাচনে নাকি জনগণের তথা গণতন্ত্রের বিজয়ই তারা দেখতে চান। একজন কমিশনার আরো স্পষ্ট করেই তার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে তারা নিজেদের কলঙ্কিত করতে চান না। তার ভাষায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ... সবার জন্য সমভাবে আইনের প্রয়োগ করা না হলে তা আইনই নয়, আইনের অবলাপ মাত্র। আইনসিদ্ধ না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে।’ অন্য এক কমিশনার এক বক্তৃতায় ভোট জালিয়াতির ঘটনা তুলে ধরেছেন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে। তার ভাষায়, ‘নির্বাচনের দিন গণমাধ্যমে দেখতে পাইÑ কোনো একজন ভোটার বলছেন, আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। অথচ এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করলে একজনের ভোট আরেকজনের দেয়ার কথা নয় (তার মানে, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না বা এটা করতে দেয়া হয় না)। তিনি আশ্বাস দেন, বিকল্প ব্যবস্থায় ভোট নেয়া হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এটি আরেকটি জাল ভোট না হলে তার উৎস কী? যাদের অবহেলায় এমনটি হয়, তার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা নিশ্চিত না হলে ‘বেড়ায় ক্ষেত খাওয়া’ কোনো দিনই বন্ধ হবে না। এখানে শুভঙ্করী ফাঁক আছে। তা হলো, কোনো কেন্দ্রে ১০০ জাল ভোট হলে বড় জোর পাঁচজন চ্যালেঞ্জ করেন। বাকি ৯৫টি তো আনচ্যালেঞ্জড থেকে যায়। আর এটি অনস্বীকার্য, অনিয়ম সবসময় শক্তির অনুকূলেই হয়ে থাকে। এখন আবার সুষ্ঠুও নয়, নিরপেক্ষও নয়, ‘গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন’ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছেন কেউ কেউ। ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ কী বস্তু?
এক কলসি বিশুদ্ধ পানির সাথে দুই-এক লিটার ড্রেনের পানি মিশালে তা কি আর বিশুদ্ধ থাকে? প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি নির্বাচনে জয়কে পরাজয় বানাতে কত লাখ ভোট লাগে? সুষ্ঠু নির্বাচনে অপারগ হলে ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের জন্য কত পারসেন্ট জালিয়াতি অনুমোদন করা যায়? কারণ একটিমাত্র ভোটের ব্যবধানেও জয়-পরাজয়Ñ এমনকি ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়া নিশ্চিত হতে পারে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে অ্যাডভোকেট আজমত উল্যাহ সোয়া লাখ ভোটে হেরেছিলেন। আর জাহাঙ্গীর আলম জিতেছেন সোয়া দুই লাখ ভোটে। অর্থাৎ আজমত উল্যাহ অপেক্ষা ‘তিন লাখ ৫০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন’। জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ার কথা স্বীকার করলেও নির্বাচন কমিশন কিন্তু ওই নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হওয়ার দাবিই করেছে।
একজন নির্বাচন কর্মকর্তা অনেকটা ব্যাংকারের মতো। কোনো ব্যাংকার যদি আমানতের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপারগ হন, তা হলে কর্তৃপক্ষ হয়তো সেই কর্মকর্তাকে চাকরি ছেড়ে দেয়ারই পরামর্শ দেবেন। একটি দোনলা বন্দুক হাতে একজন সাধারণ গার্ড যা পারেন, আনসার, পুলিশ, বিজিবি প্রভৃতি বাহিনীর যৌথ প্রহরায় নির্বাচন কমিশন এক দিনের জন্যও তা পারে না কেন? নির্বাচন কমিশনের ভোটের গরমিল কেন হবে, যখন একই জাতীয় পরিচয়পত্র আর ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা চোখের সামনে।
নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনে নিজেদের কলঙ্কিত করতে না চাইলেও কলঙ্কের কালি গায়ে মাখতে শুরু করেছে শুরু থেকেই। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না চাইলে বা আগ্রহী না হলে কলঙ্ক পিছু ছাড়বে কেন? কোথায় অনিয়ম বা পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে তা অনুসন্ধান ও প্রকাশ করাই যদি পর্যবেক্ষক আর সাংবাদিকদের দায়িত্ব হয়, কেন্দ্র বা বুথে প্রবেশের জন্য তাদের অনুমতি নিতে হবে কেন? পরিচয়পত্র তাহলে দেয়া হলো কেন? মোবাইল নিতে পারবেন না, ছবি তুলতে পারবেন না, কথা বলতে বা কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না, অনুমতি ছাড়া কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন না, এমনকি কোনো কিছু স্পর্শও করতে পারবেন নাÑ এমন কথা তো কোনোদিন শোনা যায়নি।
এটি দুঃখজনক বাস্তবতা যে, যে যুবকের বয়স আজ ৩৫ বছরের মধ্যে তিনি হয়তো এবারই প্রথম তার ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বপ্ন দেখছেন। আর সংখ্যার দিক থেকে তারাই সংখ্যাগুরু। গত ১৮ বছর ধরে প্রকৃত অর্থে বাপ-চাচাদের সাথে ওরাও ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত। সুষ্ঠু নির্বাচনটা কী? ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবেন সম্পূর্ণ নির্ভয়ে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে; নিজের ভোট নিজেই দেবেন অন্য কেউ নয় এবং অন্য কারো নয়। ভোটের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকবে শত ভাগ, অর্থাৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভোট বাতিল হবে না বা হারিয়েও যাবে না। প্রতিটি ভোট যথাযথভাবে গণনা ও রেকর্ডভুক্ত হবে; ‘লেখার ভুলে’ ২৭, ৭২ হয়ে যাবে না বা ৪ পারসেন্ট হয়ে যাবে না ৪০ পারসেন্ট। ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর মাধ্যমে বিজয়ীকে পরাজিত করা হবে না। নির্বাচনসংক্রান্ত আপত্তি ও অভিযোগগুলোর বস্তুনিষ্ঠ ফয়সালা ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই করার নিশ্চয়তাসহ উল্লিখিত পরিস্থিতিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্ব শর্ত বলা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন কলঙ্কিত হতে যে চাচ্ছেন না তার সর্বশেষ নমুনা কী এই যে, কোনো কারণ ছাড়াই ‘উপরের নির্দেশে’ কারো কারো মনোনয়নপত্র গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে? মনোনয়ন বাছাই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩৫ শতাংশই বাদ পড়ে যায়। তাদের মধ্যে হাতেগোনা দুই-চারজন ছাড়া সবাই বিরোধী জোটের! যেনতেন কারণে অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, যেমনটি অতীতে ঘটেনি। এটা কি নিরপেক্ষতার দৃষ্টান্ত যে, একই ধরনের ভুলের জন্য এক জনেরটা বাতিল হলেও অন্য জনেরটা বৈধ রয়ে যায়? অভিযোগ রয়েছে, ফাইল থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে কারো কারো ক্ষেত্রে। মনোনয়ন বাছাইয়ের সুবাদে জাতি আরো জানতে পারল গত পাঁচ বছরে অনেকের সম্পদ বেড়েছে ১০ গুণ বা তারও বেশি। এ ধরনের ভাগ্যবানদের সবাই বিশেষ মার্কার প্রার্থী। তবে নৌকা প্রতীকের কারো বিরুদ্ধে নাকি কোনো মামলা নেই, অন্য দিকে বিরোধী জোটের হয়তো একজনও নেই মামলা ছাড়া। এর মধ্যে শতাধিক মামলায় অভিযুক্তও আছেন। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে মামলা হামলায় ধরপাকড়ও ততই বেড়ে চলেছে। তার পরও বলা হচ্ছে, সরকার খালি মাঠে গোল দিতে চায় নাÑ নির্বাচন কমিশনের ধারণাও কি এটাই?
বিশ্বব্যাপী বিতর্কিত ও পরিত্যক্ত হলেও সিইসি ইভিএমের পক্ষে। উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলোকেও এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই যেন নিতে চাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য ভারতের তুলনায় ১১ গুণ বেশি অর্থ ব্যয়ে নাকি কেনা হচ্ছে ইভিএম। পরীক্ষামূলকভাবে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শÑ এটা পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্প হিসেবেই নেয়া হচ্ছে, সুতরাং ছয়টি নির্বাচনী এলাকার পরিবর্তে ছয়টি কেন্দ্রেই তা প্রয়োগ করা হোক এবং এই ছয়টি কেন্দ্রে প্রচলিত পদ্ধতিও বহাল রাখা হোক। এতে প্রতি ভোটার দু’টি করে ভোট প্রদান করবেন যাতে ইভিএমের কার্যকারিতা নির্ভুলভাবে নিরূপণ করা যায়।
‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কলঙ্ক’ এড়াতে চাইলে প্রথমত শপথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত থাকুন, অন্য কারো নয়। সম্ভব হলে সব কেন্দ্র ও বুথ (যতটা পারা যায়) সিসি ক্যামেরার আওতায় আনুন। ইভিএমের চেয়ে এতেই কাজ হবে বেশি। জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করুন। রহস্যজনক বিষয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ থেকে বহু শ্রম ও অর্থ ব্যয়ে এটি তৈরি করা হলেও নির্বাচন ছাড়া আর সব কাজেই এর ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। হ


আরো সংবাদ



premium cement