২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

-

গত ২২ নভেম্বর ছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এর আত্মপ্রকাশ ১৯৭৯ সালের এই দিনে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তিনজন যোগ্য শিক্ষককে তার কর্ণধার বানাতে পারা। প্রদান করতে পেরেছে মোট ২০ হাজার ৬৯১ জনকে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি এবং এক হাজার ৬৫ জন গবেষককে উচ্চতর ডিগ্রি।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতার পর প্রথম এবং দেশের সপ্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তদানীন্তন বঙ্গে আরবি ইসলামি শিক্ষার উচ্চতর পঠন-পাঠনের জন্য ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলিয়া মাদরাসা। ১৮৩৭ সালে সরকারি এক নির্দেশে আলিয়া মাদরাসায় বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষার আশানুরূপ ফল না হওয়ায় ১৮৫৮ সালে এ প্রতিষ্ঠান বিলোপের সুপারিশ আসে। কিন্তু মুসলমানদের আন্দোলনের মুখে সেই যাত্রায় আলিয়া মাদরাসা রেহাই পায়। এরপর থেকে উপমহাদেশে মুসলিম মনীষী ও শিক্ষাবিদরা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করতে থাকেন। ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে মওলানা আকরম খাঁকে সেক্রেটারি এবং মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে জয়েন্ট সেক্রেটারি করে গঠিত, আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিল। ১৯১২ সালে ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদসহ ঢাকায় একটি আবাসিক ‘মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠারও দাবি ওঠে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগসহ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে বহু কমিশন গঠিত হয়েছে কিন্তু ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ১৯৭৪ সালে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বেসরকারিভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি প্রফেসর এম এ বারীকে সভাপতি করে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি স্কিম ৭৭ গঠন করা হয় যার সুপারিশে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের মাঝামাঝি শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে ১৭৫ একর জমির ওপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৮০/৩৭ পাস হলে ১৯৮১ সালের ৩০ জানুয়ারি ড. মমতাজ উদ্দীন চৌধুরীকে এর প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেয়া হয়।
তৎকালীন সেনাশাসক এরশাদ ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাইয়ের এক আদেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে স্থানান্তর করেন। ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের ২৮ জুন আলকুরআন ওয়া উলুমুল কুরআন ও উলুমুল তাওহিদ ওয়াদ দাওয়াহ বিভাগ এবং ব্যবস্থাপনা ও হিসাব বিজ্ঞান-এ চারটি বিভাগ আটজন শিক্ষক এবং ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। এখানে মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অবারিত সুযোগের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সব বিভাগে ১০টি কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে বোর্ডবাজার থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরের ঘোষণা আসে। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথমবারের মতো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর হারুন উর রশিদ আসকারী গত ২১ আগস্ট ২০১৬ সালে ১২তম ভিসি হিসেবে যোগদান করে অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এনেছেন। এই প্রথমবারের মতো এ বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার পদে কৃতী তিন শিক্ষককে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি অনুষদের ৩৩টি বিভাগের মধ্যে ২২টি বিভাগে ¯œাতকোত্তর, এমফিল এবং পিএইচডি, ইসলামিক রিসার্স ইনস্টিটিটিউটে ভাষা কোর্স, বিএড এবং এমএড কোর্স, বেশির ভাগ বিভাগেই ¯œাতকোত্তর সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে, যার কার্যক্রম ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলবে। ফাজিল (¯œাতক) পাস ও ৩১টি মাদরাসায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাজিল ¯œাতক (অনার্স) কোর্স রয়েছে। ২০১৫ সালে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ায় মাদরাসাগুলো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অর্জন তুলনামূলকভাবে কম নয়। এগুলো হলোÑ ১. বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি অনুষদাধীন ৩৪টি বিভাগ, আটটি আবাসিক হল, একটি ইসলামিক রিসার্স ইনস্টিটিউট এবং একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে। পাঁচটি অনুষদে (তিনটি অনুষদের কার্যক্রম চলতি শিক্ষাবর্ষে শুরু হয়েছে) শিক্ষার্থী (ছাত্র ৯১২৪ জন + ছাত্রী ৪৫৪৯ জন) মোট ১৩ হাজার ৬৭৩ জন। স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে মোট আসন (সাধারণ ২২৭৫ + কোটা ১৬১) দুই হাজার ৪৩৬টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ভবন ৫৫টি। এ পর্যন্ত চারটি সমাবর্তন ও রজতজয়ন্তী উৎসব পালন করা হয়েছে। ২. পাঁচটি অনুষদে পাঁচটি, কেন্দ্রীয়ভাবে একটি, ইসলামিক রিসার্স ইনস্টিটিউট থেকে একটি, আলকুরআন, দাওয়াহ, আরবি, বাংলা, ইংরেজি এবং রাষ্ট্রনীতি বিভাগ থেকে একটি করে মোট ১৩টি গবেষণা জার্নাল নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ৩. ২২টি বিভাগ এ পর্যন্ত সর্বমোট (থিওলজি অনুষদ-৪৮৬৫ + মানবিক অনুষদ-৮৩৩৪ + ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ-২৫২৯ + আইন ও শরিয়াহ অনুষদ- ১৬৬৮ + বিজ্ঞান অনুষদ- ৩২৯৫) ২০ হাজার ৬৯১ জনকে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করেছে। ৪. স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি ১৯৯৪-২০১৮ পর্যন্ত মাত্র ২৫ বছরে ৬৩২ জন এমফিল এবং ৪৩৩ জনকে পিএইচডি, অর্থাৎ এক হাজার ৬৫ জন গবেষককে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করেছে। বর্তমানে (এমফিল ২৮৫ জন + পিএইচডি ৩৫৭ জন) মোট ৯৬৯ জন গবেষণারত আছেন। ৫. ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক (প্রফেসর ১৯৮ জন + সহযোগী ৫৯ জন + সহকারী ৯১ জন + প্রভাষক ৬২ জন) ৪১০ জন। এদের মধ্যে পিএইচডিধারী শিক্ষক ২০১ জন, মহিলা ৬৪ জন এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র শিক্ষক দুই শতাধিক। বিভিন্ন অনুষদের অধীনে নয় শতাধিক পিএইচডি ও জাতীয় সেমিনার এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে জাতির আশা, অন্যান্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐশী জ্ঞানের সাথে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় করে ইসলামের বিষয়ে মৌলিক ধারণাসহ বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে সুনাগরিক হিসেবে দেশ-জাতির উন্নয়নে নিবেদিত হবেন। কিন্তু এর কারিকুলাম ও সিলেবাস সে অনুযায়ী না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এসব বিভাগে ইসলামিক স্টাডিজ কোর্সটিও নন-ক্রেডিট হওয়ায় এবং কোনো কোনো বিভাগে সে বিষয়ের শিক্ষক না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। তাই আশুপ্রয়োজনÑ ১. ইসলামি শিক্ষার সাথে আধুনিক অন্যান্য শিক্ষার সমন্বয় করে বিশেষ শিক্ষাচর্চা। ২. স্নাতক ও স্নাতকোত্তরপর্যায়ে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ৩. ইসলামি জ্ঞান-গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থ বরাদ্দসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। ৪. ইসলামিক স্টাডিজ কোর্সকে ক্রেডিট কোর্স করে এ বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে পাঠদান। ৫. প্রতি বিভাগে অন্তত দু’টি করে ইসলামিক স্টাডিজ (নন-মুসলিমদের জন্য তাদের নিজ নিজ ধর্মের) কোর্স চালু করা। ৬. ইসলামি শিক্ষাবিষয়ক আরো অনুষদ ও বিভাগ চালু। ৭. গবেষকদের জন্য আবাসিক সুবিধাসহ স্কলারশিপের ব্যবস্থা। ৮. ‘বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা’ পুনঃপ্রকাশ। ১০. অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিক বিবরণী প্রকাশ করা। ১১. প্রতি অনুষদে বছরে অন্তত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার। ১২. একাডেমিক ভবন ও হলগুলোর ইসলামি ব্যক্তিত্বের নামে নামকরণ।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে গঠিত বিভিন্ন কমিশনের বিভিন্ন মনীষী যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার বাস্তবায়নই সময়ের দাবি। আধুনিক শিক্ষার সাথে ইসলামি শিক্ষার সমন্বয় করে বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করাই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মূল ধারায় ফিরে আসুক, এটাই দেশ ও জাতির প্রত্যাশা। হ
লেখক : প্রফেসর, আলকুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও রচয়িতা ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থ
drsaif.siddiqi@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন : প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের চুয়াডাঙ্গায় হিট‌স্ট্রো‌কে যুবকের মৃত্যুর ৭ ঘণ্টা পর নারীর মৃত্যু ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াল, যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৬ শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল

সকল