২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উন্নয়নের পূর্বশর্ত বিকশিত বিবেকবোধ

-

আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়াবলির মধ্যে ‘উন্নয়ন’ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও তাৎপর্যবহ। টেকসই নিরাপদ ও ভারসাম্যপূর্ণ শান্তির জীবন বিনির্মাণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুস্থ, সুন্দর, শান্তি ও নিরাপদ জীবন কে না আশা করে? পৃথিবীতে যত প্রকার কর্মযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার মূল লক্ষ্য হলো উন্নয়ন। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নয়ন সাধনের যত প্রকার কর্মকৌশল রসেবার আগে মানবিক মূল্যাবোধের উন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, চারিত্রিক, সামাজিক উন্নয়নে আধুনিক বিশ্বের সফল রাষ্ট্রগুলো নানা ধরনের পরিকল্পনা ও অনুশীলন অব্যাহত রেখেছে। বেশির ভাগ রাষ্ট্র জাগতিক বৈশ্বিক কারণে নিজেদের প্রয়োজনে রত রয়েছে মানব রচিত মতবাদের রপ্তযজ্ঞে। পৃথিবীর বেশির ভাগ তথাকথিত বুদ্ধিজীবী উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে মতবাদ জাতির সামনে পেশ করেন তা নশ্বর। অথচ তারা জানেন না, উন্নয়ন একটি সর্বজনীন শাশ্বত অকৃত্রিম। সৃষ্টি যখন স্রষ্টার বিধিবিধান অমান্য করে নিজেদের ইচ্ছেমতো মতবাদ সৃষ্টি করে সে অনুযায়ী পথ চলতে থাকে, আপাতদৃষ্টিতে সেটি উন্নয়ন বলে বিবেচিত হলেও কালের বিবর্তনে সে উন্নয়ন ধ্বংস হয়ে যায়। এটি পৃথিবীর দেড় শ’ কোটি বছরের বাস্তব ইতিহাস। এ ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, স্রষ্টার বিধান অনুসরণের মধ্যেই মানবজাতির জাগতিক ও পারলৌকিক চিরস্থায়ী উন্নয়ন ও সফলতা সম্ভব।
সাধারণ দৃষ্টিতে অনেকে মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নই উন্নয়নের চাবিকাঠি। যেমন : কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, মিডিয়া, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রাকৃতিক জগতে উন্নয়ন সাধন হলো উন্নয়ন। সেই সাথে আইন, বিচার ও প্রশাসনিক এবং প্রচলিত গণতন্ত্রের উন্নয়নই উন্নয়ন। আসলে এসব উন্নয়নের উপাত্ত মাত্র। আসল উন্নয়ন হলো মানবিক ও চারিত্রিক উন্নয়ন। এ দু’টি উন্নয়নের শর্তকে বাদ দিয়ে যে উন্নয়ন হয়, তা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায়।
কারণ, মানবতা ও মানবাধিকার পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হলে বিশ্বের বনিআদম ত্রিমাত্রায় বিভক্ত হয়ে পড়ে : শাসক, শাসিত ও শোষিতে। এমতাবস্থায় শাসিত ও শোষিতরা শাসকদের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রাম শুরু করে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। এ সংগ্রাম কখনো সফল হয় আবার কখনো পরাজয় বরণ করে। মূলত এ ধরনের শ্রেণীসংগ্রাম সফলতা ও মুক্তির আসল ঠিকানা নয়। শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানব জাতির জন্য মহামুক্তির সর্বজনীন শাশ্বত সংবিধান ছাড়া প্রকৃত মুক্তি ও শান্তি আসতে পারে না। অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও আকাশ অপসংস্কৃতিতে গোটা পৃথিবী অশান্তির দাবানলে পতিত। এ অবস্থা থেকে মহামুক্তির একমাত্র রাজপথ হলো ওহির বিধান।
বিশ্বে এখন ক্ষমতার দাপট, যুদ্ধ, মানুষ হত্যা ও অসভ্যতা চর্চা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মানুষ সার্বক্ষণিকভাবে প্রাকৃতিক ও জাগতিক পরিবেশ দূষণের শিকার। জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে সার্বক্ষণিকভাবে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে। মারণাস্ত্রের ঝনঝনানি, আণবিক, পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ভয়ে পৃথিবীর সর্বত্র প্রাণিজগৎ ঝুঁকি ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে জীবনাতিবাহিত করছে।
এমন ক্রান্তিকালে উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় বৈকি। প্রয়োজন জাগ্রত বিবেকের বিকশিত চেতনা। যে চেতনা ক্ষমতাশীলদের আবেগের পরিবর্তে বিবেকের মূল্যবোধ জাগ্রত করবে। সঙ্ঘাতময় নশ্বর পৃথিবীতে বিনাযুদ্ধেই একটি সবুজ নির্মল, শান্তিময়, নিরাপদ ও বাসযোগ্য নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন প্রকৃত মানবতাবাদী, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বদানকারী নেতার আজ বেশি প্রয়োজন। যাদের নেতৃত্বে জাগতিক ও পারলৌকিক সফলতা অনিবার্য অনস্বীকার্য। যারা প্রতিষ্ঠিত করবে সুশাসন, মানবাধিকার ও সত্যিকারের অর্থবহ টেকসই উন্নয়ন। দেশ, জাতি ও বিশ্ব এমন নেতৃত্বদানকারীদের জন্য প্রহর গুনছে।
ক্ষমতা আর মমতার মহামিলনের মধ্যে দিয়েই গণতন্ত্র, মানবতা ও উন্নয়নের সন্তান প্রসব করে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন টেকসই করতে শাসকদের ইতিহাস ও দর্শন থেকে শিক্ষা নেয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আজকাল বিশ্ব নেতারা বিশেষ করে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার শাসকগোষ্ঠী ইতিহাস ও দর্শনের তোয়াক্কা করে না। তারা ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে নিজেদের সুবিধামতো আইন রচনা করে সেগুলো বাস্তবায়নে জোর খাটায়। ফলে সাময়িকভাবে তারা আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে নিজেদেরকে ক্ষমতাধর মনে করে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই শ্রেণীর ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব নিমেষেই ধ্বংস হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। কথায় আছে চরিত্র হারালে সর্বস্ব হারায়। তাদের সমকালীন দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন, বৈশ্বিক উন্নয়ন সাফল্যমণ্ডিত হবে তখনই যখন চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধিত হবে। ন্যায়বিচার, সমতা, ক্ষমতা, মমতাসহ, মানবিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতের মানবকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করাই যাদের কাজ, তারা কি সেসব চর্চা করেন? কথায় আছে গর্জনের চেয়ে অর্জন বড়। গোটা পৃথিবীতে ক্ষমতাসীনদের অর্জনের চেয়ে গর্জনের মাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না। একটি দেশ-জাতি যখনই উন্নয়ন লাভ করবে তখন সে দেশের ক্ষমতাসীনেরা গর্জনের চেয়ে অর্জন বেশি করবেন।
উন্নয়নের পূর্বশর্ত বিশ্বাস, সততা ও আমানতদারিতার উৎকর্ষ সাধন করা। সেই সাথে মানবতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ নিশ্চিয়তা বিধান করা। আজকের প্রাণিজগৎ এ যাবত যত উন্নয়ন সাধন করেছে, এসব উন্নয়নের উপাত্ত দেখে যে গর্ব অহঙ্কার করছে তা মূলত ইসলামের সৌন্দর্য ও সফলতার চেয়ে অনেক কম। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় স্বকীয়তা ওহির বিধান মোতাবেক পরিচালিত ও বিনির্মিত হয়। আর যত সব জীবনব্যবস্থা ও উন্নয়ন ঘটিয়ে থাকে তা খণ্ডিত ও অস্থায়ী হিসেবে পরিগণিত হয়। কাজেই সামগ্রিক উন্নয়নকে টেকসই ও উন্নয়ন করতে হলে ঐশী বিধানের কোনো বিকল্প নেই, একথা ১০০% নিশ্চিয়তার সাথে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করা যায়।
মানুষের জ্ঞান সীমিত, এ সীমিত জ্ঞান দ্বারা সামগ্রিক উন্নয়নের অসমপ্রতিযোগিতার অস্থিরতা একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষ যদি বুঝত যে তাদের রচিত জীবনবিধান দ্বারা টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাহলে চিরস্থায়ী শাশ্বত জীবনবিধানের ব্যবস্থাপত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে অনুসরণ করত। এতে মানব উন্নয়নের সমগ্র বিষয়ের উত্তম ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান আলোচিত হয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সমস্যার সমাধানে বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস করে সে মোতাবেক পথ চলা। এ ক্ষেত্রে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা। ইসলাম জাগতিক, উচ্চভিলাষ, জাঁকজমকপূর্ণ, আড়ম্বর জীবনযাপনকে সমর্থন করে না। সাবলীল, সম, অল্পতুষ্টিতেই স্বস্তি ও শান্তির প্রাচুর্যময় জীবনকে ইসলাম পছন্দ করে। তাইতো ইসলাম একটি অন্ধকার বিশ্বকে আলোর পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছে, যা একাধারে পাঁচ শ’ বছর টেকসই হতে সক্ষম হয়েছে।
তাহজীব-তমাদ্দুন তথা সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-দর্শন, চর্চা ও বিকাশ ইসলামের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এ অস্ত্র দিয়েই অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করা সম্ভব। অপশাসন, দুঃশাসন ও অপরাজনীতির শিকড় মূলোৎপাটন করে প্রকৃত মানবতার কল্যাণমূূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই নিরাপদ ও বাসযোগ্য নির্মল পৃথিবী বিনির্মাণে আমাদের সে ইসলামের পথেই এগোতে হবে। এ ছাড়া মুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের বিকল্প কোনো পথ নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রকৃত মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের দীর্ঘদিনের অর্জিত অভিজ্ঞতা বিকশিত করার যথার্থ মূল্যায়ন করা দরকার। আজকের বিশ্ব প্রকৃত বিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের যথার্থ মূল্যায়ন না করে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি ও পুরস্কার দেয়ার মাধ্যমে সভ্যতার পরিবর্তে অসভ্যতার চর্চাকে উসকে দিচ্ছে। এ কারণে টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। হ
লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক
dr.mizanur470@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ক্যাপ, পানি ও স্যালাইন বিতরণ করেছে ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগর পশ্চিম নোয়াখালীতে হিট স্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় স্ত্রীর ২৭ স্থানে স্বামীর ধারালো অস্ত্রের আঘাত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ১২ উপজেলায় মানববন্ধন রোববারই খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবার ক্লাসসহ ৪ নির্দেশনা ময়মনসিংহ ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ঈদ পুনর্মিলনী বাস্তবায়নের আহ্বান ৩ গণকবরে ৩৯২ লাশ, ২০ ফিলিস্তিনিকে জীবন্ত কবর দিয়েছে ইসরাইল! মৌলভীবাজারে বিএনপি ও যুবদল নেতাসহ ১৪ জন কারাগারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট কারীদের চিহ্নিতকরণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ১২ দলীয় জোটের কলিং ভিসায় প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরার সময় মারা গেল মালয়েশিয়া প্রবাসী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিবকে আটকের অভিযোগ

সকল