নারী সাংবাদিক হত্যা নিরাপত্তার দায়
- সিরাজ প্রামাণিক
- ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
এবার পাবনায় নারী সাংবাদিক সুবর্ণা নদীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ২৮ আগস্ট রাত ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে। সুবর্ণা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘আনন্দ টিভি’র পাবনা প্রতিনিধি। পাশাপাশি দৈনিক জাগ্রতবাংলা পত্রিকায় পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, পাবনা পৌর সদরের রাধানগর মহল্লায় আদর্শ গার্লস হাইস্কুলের সামনে সুবর্ণার বাসার কলিং বেল টেপে কয়েকজন দুর্বৃত্ত। এ সময় সুবর্ণা গেট খোলার সাথে সাথে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে সুবর্ণাকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ২১ বছরে রাজধানীসহ সারা দেশে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৮টি। বিভিন্নভাবে ২৮ জন সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হয়নি। দুর্বল তদন্ত ও শক্তিশালী মহলের চাপের কারণে খালাস পেয়ে যাচ্ছে আসামিরা। ২০০২ সালে খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চলের সিনিয়র রিপোর্টার হারুন উর রশিদ হত্যা এবং ২০০৪ সালে খুলনা প্রেস ক্লাব সভাপতি দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে। অন্যান্য মামলা ঝুলে আছে। এ পর্যন্ত যত সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ফরিদপুরের গৌতম ছাড়া কোনো হত্যার বিচার হয়নি। সে ক্ষেত্রেও নিশ্চিত হয়নি সর্বোচ্চ শাস্তি। মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ( সিপিজে)-এর তথ্য মতে, সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক হত্যার বিচার এড়ানো দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে। দেশের প্রতিটি সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতা নির্মম। প্রায় প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রতিটি সরকারের সময়ে, সব ধরনের পরিস্থিতিতে। কখনো শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, কখনো শিকার হচ্ছে হয়রানির। কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, কখনো রাষ্ট্রের হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে খড়গ। হামলা, মামলা আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন। সম্প্রতি সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহকালে সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলা এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলে লাইভ ও সংবাদ প্রচারের ওপর বিধিনিষিধ আরোপের বিষয়টি ছিল রীতিমতো অশনী সঙ্কেত।
গণমাধ্যমের এ আক্রান্ত অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র যে রুগণতম সময় পার করছে তা অনুমেয়। কেননা, গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র অবস্থানের দিক থেকে একই সুতোয় গাঁথা। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করলেও পুলিশি নির্যাতনেরও শিকার হতে হয় সংবাদকর্মীদের। যদিও উভয়ই ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে। কিন্তু রাজপথে, বিপজ্জনক মুহূর্তে মাঝে মধ্যে পুলিশই হয়ে পড়ে সাংবাদিকের প্রতিপক্ষ। পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতির ঝাল মেটান সাংবাদিকদের ওপর। পরে ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো মৌখিক দুঃখ প্রকাশও করেন। এটুকুতেই প্রতিকারের সমাপ্তি। একইভাবে রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকের সম্পর্ককে আখ্যায়িত করা হয় জল ও মাছের সম্পর্কে। কিন্তু যতই বস্তুনিষ্ঠ হোক, নিজের বা নিজ গ্রুপের বিপক্ষে গেলেই প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েন রাজনীতিবিদেরাও। তারাও হুমকি-ধমকি দেন, কর্মক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে সাংবাদিকদের ‘উপহার’ দেন বেকারত্ব। নিজস্ব সুবিধাবাদীদের দিয়ে মামলায় জড়িয়ে দেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। আমলারা করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা হয়রানি। সাংবাদিকতার নৈতিকতায় সাংবাদিকেরা কারো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হতে পারে না। অনিয়মের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফলে সাংবাদিকেরা হয়ে পড়ে অপছন্দের পাত্র। তাদের গলা টিপে ধরতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে সবাই। অথচ অপছন্দের কথাগুলো তুলে ধরতে হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের সময়েই সাংবাদিকদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংবাদিকেরা নির্যাতিত হচ্ছেন তা-ই নয়, স্বার্থান্ধ রাজনীতিবিদদের ক্যাডার ও সন্ত্রাসী চরমপন্থীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত, এমনকি খুন হচ্ছেন সাংবাদিকেরা।
প্রতিটি সরকারের সময়কাল রঞ্জিত হয়েছে সাংবাদিকের রক্তে। অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকারই থাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের হাতেই প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচারপ্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখ প্রকাশ ও হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
প্রতিদিন সংবাদপিপাসু মানুষের দুয়ারে নতুন নতুন খবর নিয়ে হাজির হন সাংবাদিকেরা। তাদের লেখনী বা সংবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে সকালে চায়ের কাপে ঝড় থেকে শুরু করে মানুষ সুফল পেতে শুরু করে। নির্যাতিত মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে সাংবাদিকদের দ্বারস্থ হয়। আর সাংবাদিকেরা জাতির সামনে তুলে ধরেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না-সাফল্য-ব্যর্থতার কথা। কিন্তু সেই সাংবাদিক যখন নির্যাতিত হন তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজো আমাদের রাজপথে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের পৈশাচিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার দাবি করতে হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিচার না হলে সাহসী সাংবাদিক ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে না আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। তাই সরকার, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন রাখছি, সুষ্ঠু বিচার, প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থা গ্রহণের। সাংবাদিকদের পেশায় এ চলমান ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নেবে? দূরভবিষ্যতে কি কোনো উজ্জ্বল আলো অপেক্ষা করছে? হ
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
seraj.pramanik@gmail.com