২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এবার কাকলীদের জন্যই কোটা চাই

-

‘জিপিএ ৫ পেয়েও কাকলীর পরিবারে কান্না’ শিরোনামে গত ২৩ জুলাই নয়া দিগন্তে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি নজরে পড়ার মতো। বারবার নদীভাঙনের শিকার সর্বহারা এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান কাকলী। মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজ থেকে এবার জিপিএ ৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে সে। উল্লেখ্য, পুরো উপজেলায় জিপিএ ৫ পাওয়ার সৌভাগ্য এবার একমাত্র কাকলীরই। এত বড় অর্জনের পরও কান্না!
বিত্তবানদের ছেলেমেয়ের মতো কাকলীর বাবা প্রতিটি বিষয়ের জন্য শিক্ষক দেয়া তো দূরের কথা, ফ্রি না দিলে কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগই পেত না। যাতায়াতের জন্য তার কোনো গাড়ি ছিল না। ফ্যান-লাইট তো দূরের কথা, কেরোসিনের বাতিই হয়তো তাদের জন্য অপব্যয়ের শামিল। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, লেখাপড়া নামে বিলাসিতায় কেরোসিনের ‘অপচয়’ মেনে নিয়ে রাতে প্রয়োজনমতো পড়ালেখার সুযোগ যেমন তার হয়নি, তেমনি চাহিদামতো বই-খাতা-কলমও যে তার ভাগ্যে জোটেনি তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও এলাকার কিছু সদয় ব্যক্তির সহযোগিতা ছাড়া তার পক্ষে এ পর্যায়ে পৌঁছাও সম্ভব ছিল না। এ জন্য তারা প্রশংসার যোগ্য বটে। কিন্তু আমাদের সংবিধানে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন ও সার্বজনীন অধিকারের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছেÑ কাকলীদের সেই অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির অবদান কী? বরং বাস্তবতা এই, আমাদের পরিসংখ্যান বিভাগ ভাগ্যবানদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এ সমাজে কাকলীদের সংখ্যা কত বা এই মধ্যম আয়ের গৌরবময় অধ্যায়ে প্রবেশের শুভ লগ্নে তাদের দিন-রাত কিভাবে কাটে তার ওপর কোনো পরিসংখ্যান আজ অবধি হয়েছে কী? আকাশ জয়ের এ দিনেও ঝরে পড়া কাকলীদের হিসাবও আমরা কেউ রাখি কি? তবে এক হিসাবে জানা যায়, এ দেশে কাকলীদের স্বগোত্রীয় গার্মেন্ট কর্মীর সংখ্যা নাকি ৫০ লাখ। অন্য কথায় বলা যায়, ৫০ লাখ পরিবার শুধু এই শিল্পের ওপরই নির্ভরশীল। জাতীয় অর্থনীতিতে এদের অবস্থান বা অবদান নাকি হৃৎপিণ্ডের মতো (?) এ হিসাবে ক্যাডেট কলেজ, মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক-পঞ্চমাংশ তাদের ছেলেমেয়েদের দিয়েই তো পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা নিতান্তই প্রতারণামূলক বলা হলে অসত্য বলার অভিযোগ আনা যাবে কী? অথচ গণতন্ত্রের মতোই সমাজতন্ত্রও আমাদের সংবিধানের অন্যতম অঙ্গীকারই বটে!
আমার বড় ছেলে প্রাথমিকে যে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল, তাদের ক্লাসে সবসময় যে মেয়েটি প্রথম হতো; পঞ্চম শ্রেণীর পর তার আর পড়ার সুযোগ হয়নি। আমার ছেলে এমবিএ পাসের খবর শোনার সাথে সাথে সেই মেয়েটির কথাই মনে আচমকা জেগে উঠল। রাষ্ট্র তার প্রতি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ না হলে সে হয়তো আরো বড় কিছু হতে পারত।
আরেকটি উদাহরণ না দিলেই নয়। প্রায় তিন দশক আগের কথা। আমাদের অফিসের এক গার্ড, তার বড় ছেলে তখন সস্তম শ্রেণীর ছাত্র। বিষয়ভিত্তিক প্রাইভেট শিক্ষক তো দূরের কথা, খাতা-কলম-বই কোনো কিছুরই জোগান নেই প্রয়োজনমতো। তবু সবসময় সে-ই ক্লাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রথম।
ছেলেকে নিয়ে তার কত স্বপ্ন, তা মাঝে মধ্যে শেয়ার করতেন। হঠাৎ তিনদিনের জ্বরেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির অনন্ত জগতে পাড়ি দেয়ায় দিশেহারা হয়ে যায় পরিবারটি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বড় মেয়েকে অপরিণত বয়সেই বিয়ে দিতে হলো আইন ভঙ্গের দায় সরকারের না পরিবারের সে প্রশ্নের মীমাংসা মুলতবি রেখেই। বছর পাঁচেক পরের ঘটনা, ততদিনে আমি বদলি হয়ে এসেছি চাঁপাইয়ে। জীর্ণ বস্ত্র শীর্ণকায় এক কিশোর ছালাম দিয়ে দাঁড়াল সামনে। প্রথম দর্শনে চিনতে কষ্ট হলেও ঘোর কাটতে দেরি হলো না। ‘লেখপড়া করো’ জানতে চাইলে সে বললÑ ‘স্যার, আমি এখন রিকশা চালাই।’ রিকশা চালানোর কষ্ট সে আর সইতে পারছে না। তার উপর ঝুঁকি তো আছেই। তাই সে এসেছে বড় প্রত্যাশা নিয়ে কোথাও কোনো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি কি না?
প্রসঙ্গত, সমাজে কাকলীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে? পরিসংখ্যান দফতরে এর সঠিক জবাব না থাকলেও পর্যবেক্ষণে মনে হয়Ñ ঢাকা শহরে ‘হাইরাইজিং’ ভবনের সংখ্যা যে গতিতে বাড়ছে কাকলীদের সংখ্যাধিক্য তার চেয়েও দ্রুততর গতিতেই বাড়ছে। আর পুঁজিবাদী বা বঞ্চনামূলক অর্থব্যবস্থার এটাই নিয়ম। সুতরাং এরপরও অদম্য কাকলীদের সহযোগিতার পরিবর্তে পদে পদে অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতা করে যাচ্ছি আমরা স্ব-জ্ঞানেই। প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষায় কাকলীদের ‘উচ্চশিক্ষা’ নামক সোনার হরিণ ধরার উপায় কী?
মেধা নির্বাচনে ভর্তি পরীক্ষা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তাই বলে ভোগান্তিও জরুরি? সদ্য প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৫ পাওয়া মেধাবীদের ৪০ শতাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। অন্যান্য বড় শহর যদি আরো ৪০ শতাংশ মেধা দখলে নিয়ে থাকে, তাহলে ৮০ শতাংশ পল্লী ছেলেমেয়ের জন্য থাকে ২০ শতাংশ। মেধা প্রসবে বৃহত্তর পল্লী অঞ্চলের এ বন্ধ্যাত্বের জন্য প্রকৃতির খেয়ালিপনা না কায়েমি স্বার্থবাদী বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দায়ী, তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বোধ করি শিক্ষামন্ত্রীই ভালো দিতে পারবেন। কার পাপে যে ছেলেটি প্রকৌশলী বা পাইলট হতে পারত; সে এখন রিকশাওয়ালা? যে মেয়েটি ডাক্তার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারত; সে হয়ে গেল ভদ্রলোকদের ঝি বা কাজের বুয়া? ইট-পাথরের বোঝা মাথায় নিয়ে হাজারো প্রতিভা আজ নির্মাণশ্রমিক, অথচ অদ্ভুত ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে নারী মুক্তির!
বঞ্চিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ‘কোটা’ সাংবিধানিক অধিকার হলে সর্বহারা ভাগ্যাহত বস্তিবাসী কাকলীদের জন্য নয় কেন? রিলিফের চাল-ডালের মতোই অনগ্রসর বঞ্চিতদের কোটাও আজ ভাগ্যবান ও ভদ্রলোকদেরই কুক্ষিগত। কোটা ব্যবস্থার বিলুপ্তি নয়, বরং শিক্ষা-চাকরিসহ সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বঞ্চিত ও অনগ্রসর কাকলীদের জাতীয় অগ্রযাত্রায় শামিল রাখার জন্যই শুধু কোটা সুবিধার কথা চিন্তা করা উচিত এবং তা সংখ্যা অনুপাতে। কোটা অনুগ্রহ বা দান নয়, এটা সাংবিধানিক অধিকার হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। কাকলীদের পেছনে ফেলে রেখে জাতীয় উন্নয়নের স্বপ্ন বাতুলতা ছাড়া আর কী হতে পারে, যখন তারাই সমাজে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ?
পত্রিকায় কাকলীর সহযোগিতার্থে দু’টি মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে। হৃদয়বানদের উদ্দেশে তা পুনঃ উল্লেখ করা হলো। নিজেদের নম্বরÑ ০১৯৮৮৩৭১৬৫৮, অধ্যক্ষÑ ০১৭১৬৩৭৭২৯৬ হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
বগুড়ায় ধানের জমিতে পানি সেচ দেয়া নিয়ে খুন জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে

সকল