২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সংবিধান ও সংসদ নির্বাচন

-

বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একাদশ সংসদ নির্বাচন আগামী জানুয়ারির মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি বলেছেন, ‘বড় ধরনের পাবলিক নির্বাচনে অনিয়ম হবে নাÑ এ রকম নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না’। বাস্তবতা উপলব্ধি থেকেই তিনি কথাটি বলেছেন। কিন্তু সংবিধানের গুরু দায়িত্ব পালন করতে হলে সাংবিধানিক আদলেই নির্বাচনী পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে দেশের স্বার্থে। কায়েমি স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে সবার আগে। তিনি যদি পেশিশক্তিনির্ভর নির্বাচন ঠেকাতে না পারেন তাহলে তা দরকারই বা কী? নির্বাচনে যার পেশিশক্তি বেশি সে দুপুরের আগেই সিল মেরে বাক্সবন্দী করে ফেলবে। আর যারা সুপ্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য রয়েছেন তাদের ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট থাকলে গায়ের জোরে তাদের বের করে দেয়া হয়। গণতান্ত্রিক অথচ দেশের ভোট হবে উৎসবমুখর আমেজে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যাবে তার পছন্দনীয় ব্যক্তি বা দলকে ভোট দেয়ার জন্য। এখন যদি সিইসি বলেন, অনিয়ম যে হবে না তা বলা যায় না, তাহলে তিনি যদি মনে করে থাকেন, অনিয়ম ঠেকানো কোনো মতেই সম্ভব নয়, তাহলে এই সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোই উত্তম পন্থা বলে দেশের মানুষ মনে করে। আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছেÑ সংবিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন সিইসিকে ‘সংযত হয়ে’ কথাবার্তা বলতে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সিইসি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা সত্য হলে ক্ষমতাসীন দলের কোনো সদস্য এতে নাখোশ হতে পারেন না। কিভাবে সঙ্কট সমাধান করা যায় তা বিবেচনায় নিয়ে দলগুলোকে চলতে হবে। গণতন্ত্র মজবুত করতে স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। অনিয়ম আর পেশিশক্তিনির্ভর নির্বাচনের ফর্মুলা রেখে গেলে তা ভবিষ্যতের জন্য লজ্জাকর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
১৯৭৩ সাল থেকে অদ্যাবধি কোনো নির্বাচনই বিতর্ক ছাড়া শেষ হয়নি এ দেশে। বিশেষ করে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের ধারায় নির্বাচন করলে তাতে গণতান্ত্রিক ধারা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। ১৯৯১ সালে এ দেশের রাজনীতিতে সংসদীয় ধারা চালু হয়েছে। নানা সঙ্কট ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গণতন্ত্র দেশের মানুষ ফিরে পেল। তা যদি কোনো পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রিত, কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বানচাল হয়ে যায় তাহলে তা দেশের ভেতর মারাত্মক ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তৈরি করবে। ‘এক-এগারো’র কুশীলবরা তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে নির্বাচন কমিশনার সত্যি কথা বলেছেন। এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু সাংবিধানিক পদে থেকে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার লক্ষ্যে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যাবে না কেন? বড় নির্বাচন না হোক, ছোট কোনো নির্বাচনেও সিইসি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেননি। এর কারণ হলোÑ ক্ষমতাসীন কায়েমি স্বার্থের জালে জড়িয়ে পড়া। সিটি নির্বাচনে যে অনিয়মের ধারা রচিত হলো তার দায় সিইসিকেই নিতে হবে। তিনটি সিটি নির্বাচনে আমরা কী লক্ষ্য করলাম? ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে কঠোর অভিযোগ থাকলেও তা নির্বাচন কমিশন আমলে নেননি। নির্বাচন হয়ে গেছে দুর্বৃত্তায়নের একটা দৃষ্টান্ত। যে দলের পেশিশক্তি যতো বেশি তারাই নির্বাচনী কেন্দ্র দখল ও সিলমারায় অগ্রগামী। তাহলে সংসদ নির্বাচন কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে? যদি দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ এবং অনিয়ম রোধ করতে না পারেন, তাহলে সাংবিধানিকভাবে এ পদে থাকার যোগ্যতা তার নেই। তাই অবিলম্বে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। কঠোরতা প্রয়োগ করে দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে না পারলে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন জাতির কোনো উপকারে আসবে না। এ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে জাতির জন্য কাজ করতে হবে। নির্বাচন যদি ত্রুটিপূর্ণ এবং দায়সারা গোছের হয়, তাহলে চরম মূল্য দিতে হবে। নির্বাচন নিয়ে গোলযোগ হলে গণতান্ত্রিক ধারা বিনষ্ট হবে। নির্বাচনী সরকারের রূপরেখা কী হবে বা তার আঙ্গিক কী হবে সে বিষয়ে এখনই আন্তরিকতার সাথে ফলপ্রসু আলোচনা চালানো উচিত। তা হতে হবে সাংবিধানিক আদলে, দায়সারা গোছের আলোচনার কোনো যুক্তি নেই। গণতান্ত্রিক একটি দেশের নির্বাচনী পরিমণ্ডল হতে হবে স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক। সেখানে যদি কারসাজির কোনো পরিকল্পনা থাকে, তাতে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হবে। আমরা গত জাতীয় নির্বাচনে সংবিধান রক্ষা করার নামে ১৫৩ আসনের অনির্বাচিত সরকারের যে রূপরেখা দেখতে পেলাম, তা কেউ আর দেখতে চায় না। তখন ১৪৭টি আসনের জন্য বিএনপিও ছাড়া ১২টি জামায়াত দল অংশ নেয় এবং ৩৮৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন, এ নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। গত কয়েকটি নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করে তারা এ কথা বলছেন। যেখানে ছোটখাটো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারেনি, সেখানে বড় নির্বাচনে যে খুব বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এ কথাই সিইসি প্রকাশ্যে বলেছেন। তবে এখনো দেশের প্রধান দলগুলোর সাথে তেমন কোনো সংলাপ হয়নি তাদের। সংলাপ হলে সেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ডাকা হবে কিনা তা এখনো অনিশ্চিত বলা চলে। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- নির্বাচনের আগে বিএনপি নেত্রীকে জেল থেকে ছাড়া হবে কি? না ছাড়লে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনই বলা যায় না। ক্ষমতাসীনেরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছেন। সে জন্য প্রশাসনিক অবকাঠামোসহ বিভিন্ন স্তরের ‘পুনর্বিন্যাস’ করে রেখেছেন।
‘করণীয়’ কাজ ক্ষমতাসীনেরা করে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। বিএনপির যে কয়েকজন এখনো সক্রিয় রয়েছে, তাদের পরিকল্পিতভাবে যদি নির্বাচনের আগেই হামলা-মামলায় ঢোকানো যায়, তাহলে ক্ষমতাসীনদের পথে আর কোনো কাঁটা থাকবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বৈরশাসক হঠাতে দেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এত আন্দোলন, অনেক সংঘর্ষ-সংগ্রাম করেছেন। আওয়ামী লীগও তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দাবিতে মাঠ গরম করে রেখেছিল। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে গিয়ে তারা তাদের অঙ্গীকার পরিবর্তন করে ফেলেছেন। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি বিএনপি করে আসছিল, তা ছিল সংবিধানের আলোকেই। দশম সংসদ নির্বাচনে দেশের দুই নেত্রীকে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব দুই বার চিঠি দিয়েছিলেন সংলাপে বসার জন্য। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন তারা সংলাপে বসে নির্বাচন সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য। কিন্তু কোনো সুফল আসেনি। তখনকার সিইসি কাজী রকিব উদ্দিনের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সবকিছু মিলিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের মধ্যে যে অমানিশার ঘোর অন্ধকারে দেশ ঢেকে গিয়েছিল, সে অবস্থা আবারো কি আমরা দেখতে পাবো? একাদশ সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি কি হবে তা আগেই ঠিক করা জরুরি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেহারা এখনই আয়নায় প্রতিফলিত করা দরকার। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে তখন সাংবিধানিক সঙ্কটের কথা বলে এই ক্ষমতাসীনেরা পার পাবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। তাই মাঝে মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদককে বলতে শুনিÑ বিএনপির নেতার সাথে মোবাইলে কথা বলবেন। তবে তারা বিরোধী দলের নেতাদের সাথে যে আচরণ করেন, তা গণতন্ত্র পরিপন্থী। বর্তমান সিইসি সাংবিধানিক একটি পদের অধিকারী। তিনি এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে করে জাতির সামনে তাকে গণতন্ত্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতে হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। মানুষ উৎফুল্ল অবস্থায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে, সে পরিবেশ নিশ্চিত করা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। হ
লেখক : সাংবাদিক
oliurrahmanferoz@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও

সকল