২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানুষ, তুমি মানুষ হও

-

কিছু দিন আগে রাজশাহী শহরের সাহেব বাজারের জিরো পয়েন্ট এলাকা দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম বিপরীত পাশে, একজন খোঁড়া মানুষ রাস্তার মাঝখানে আটকা পড়েছেন। এদিক-ওদিক কোনো দিকেই তিনি যেতে পারছেন না। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। চেষ্টা করেও তার কাছে পৌঁছতে পারলাম না। লোকটির আশপাশ দিয়ে বহু মানুষ রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। কেউ যদি একটু হাতখানা এসে ধরে তাহলে তিনি সহজেই পার হয়ে যেতে পারেন; কিন্তু কাউকে এটা করতে দেখতে পেলাম না। একজন বিপদগ্রস্ত মানুষের হাত ধরার লোকের এত অভাব কেন? নাকি তিনি দরিদ্র বলেই এত অবহেলা? মনে ভীষণ কষ্ট পেলাম। অবশ্য একজন রিকশাচালক তার রিকশা রাস্তার এক পাশে থামিয়ে লোকটিকে পার করে দিলেন। মনে মনে রিকশাচালককে ধন্যবাদ দেয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন নতুন ভর্তি হয়েছি। ‘যা দেখি নতুন লাগে’Ñ অবস্থাটা এমন। পড়াশোনার তেমন চাপ নেই। ইচ্ছামতো সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াই। একদিন বন্ধুকে নিয়ে চারুকলার ওদিকে খেতে গেলাম। আমরা দু’জন একমনে খাচ্ছি। এমন সময় বাইরে তর্কাতর্কির আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কী হচ্ছে। দেখতে পেলাম, একজন ভদ্রলোক রিকশাচালককে ধমকাচ্ছেন আর চালক কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বুঝতে পারলাম, ভাড়া নিয়েই সমস্যাটার সৃষ্টি হয়েছে। একপর্যায়ে ভদ্রলোক রিকশাচালককে গালি দিয়ে বললেনÑ জানিস, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! এটা শুনে আমি যেন মাটির সাথে মিশে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের আচরণ এত নিচু হবে কেন? আর আমরা এমন চরিত্রের শিক্ষকের কাছ থেকে কতটুকু সভ্যতা শিখতে পারব? মনে মনে বললামÑ মানুষ, তুমি মানুষ হও।
বনের পশু কখনো প্রয়োজন ছাড়া অপর কোনো পশুকে আক্রমণ করে না। হয়তো বেঁচে থাকার তাগিদে খাদ্যের প্রয়োজনে, নয়তো নিজেকে অপরের হাত থেকে বাঁচাতে তারা এই কাজটি করতে বাধ্য হয়ে থাকে। তবে সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ হয়েও মানুষ বিনা কারণে অন্য মানুষকে আক্রমণ করে। কোনো প্রয়োজন নেই, তবুও মানুষ অপরকে খোঁচা মারে। এই স্বভাবটা মানুষের মধ্যে ব্যাপক। বনের কোনো পশু অন্য পশুর উন্নতিতে মনে কষ্ট পায় কি না, জানা নেই। কিন্তু মানুষ সেই প্রাণী যে অন্যের উন্নতি দেখলে হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরে। এটাই পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী বা উন্নতি দেখে হৃদয়ে যে কাতর মনোভাব জাগ্রত হয়, তা-ই পরশ্রীকাতরতা। কেন মানুষ পরশ্রীকাতর হতে পারে?
পাশের বাড়ির ছেলেটি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে আমাদের মনে দুঃখ হয়। অমুকের ছেলে এত ভালো করল কী করে! আর নিজের ছেলে যদি কোনো কারণে খারাপ রেজাল্ট করে, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আমরা উঠেপড়ে লাগি ওকে পেছনে ফেলার জন্য। আমাদের ভেতর এই ভয়ঙ্কর অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ যদি একটি ভালো গাড়ি কেনে, ভালো একটি বাড়ি বানায়, ভালো বেতনের চাকরি করে, তাহলে আমাদের এত কষ্ট হয় কেন? আমাদের মানসিকতা এত নিচু কেন! অথচ আমাদের উচিত ছিল ভাই-ভাই হিসেবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজে বসবাস করা। এতে আমাদের নিজেদের যেমন উন্নতি হবে, তেমনি আমাদের সমাজও এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আফসোস! আমাদের ভেতর কোনো অনুশোচনার লেশমাত্রও নেই।
আমরা মিথ্যা অহঙ্কার এবং পরশ্রীকাতরতার দরুন পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছি। পরস্পরকে সাহায্য করা তো দূরে থাক, সবার সাথে ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলি না। আমাদের আচরণ আজ বনের পশুর মতো। যেন সবাই এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করছি। আমাদের ভেতর পরশ্রীকাতরতার পরিমাণটা একটু বেশিই যেন। আর কোনো জাতির মধ্যে এই মনোভাব এতটা প্রকটভাবে আছে কি না জানা নেই। একজন ব্যক্তিকে কিভাবে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনা যায়, সেটা আমরা খুব ভালোভাবেই পারি।
আমরা নিজেদের স্বার্থের জন্য যে কাজগুলো করে চলেছি, তা কোনোমতেই যথার্থ নয়। আমাদের প্রকৃত মানুষ হতে হবে। পরশ্রীকাতরতা কোনো সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক মানুষের থাকতে পারে না। প্রতিবেশী যদি আমার চেয়ে ভালো থাকতে পারে, তাতে আমার অসুবিধা কোথায়? বরং আমার উচিত তাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করা। একজনের বিপদে যদি এগিয়ে না গিয়ে অহঙ্কারবশত দূরে দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে আমার বিপদে সে-ও এগিয়ে আসবে না। আমাদের মন থেকে পরশ্রীকাতরতার বিষ ঝেড়ে ফেলতে হবে। আমাদের সব ধরনের অহঙ্কার বর্জন করতে হবে। আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে ঝেড়ে ফেলতেই হবে পারস্পরিক বিদ্বেষ। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement