১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`
সূরা আর-রহমান তেলাওয়াত করে মুগ্ধ করত জায়ান

শোকে স্তব্ধ জায়ানের পূর্ব-পূরুষের জমিদার বাড়ি ভাটিপাড়া গ্রাম

শ্রীলংকায় সিরিজ বোমা হামলায় নিহত জায়ানের পূর্ব-পুরুষের পৈত্রিক বাড়ি। (ডানে) জমিদার বাড়ি সংলগ্ন জামে মসজিদ - নয়া দিগন্ত

শোকে স্তব্ধ শ্রীলংকায় সিরিজ বোমা হামলায় নিহত জায়ানের পূর্ব-পূরুষের জমিদার বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রাম। নিহত জায়ানের দাদা মতিনুল হক চৌধুরী (পারুল)’র চাচাতো ভাই কায়জার চৌধুরী, স্বজন, প্রতিবেশী ও গ্রামবাসীরা জায়ানের জন্য কাঁদছে। গোটা পরিবারসহ এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

কায়জার চৌধুরী’র সাথে বুধবার ভাটিপাড়া জমিদার বাড়িতে গিয়ে কথা হলে এই প্রতিবেদকের সাথে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমাদের বংশের একটি প্রদীপ নিভে গেল। জায়ানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের, সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। দাদু ভাই বাড়িতে আসবে বলে আর এলো না। আমাদের বুকে সেল বিদ্ধ করে নিষ্পাপ দাদু আমার চলে গেছে। আর কোনো দিন দেখা হবে না।

জমিদার বাড়ির কেয়ারটেকার সাবির আলী চোখ মুছতে মুছতে বলেন, সাহেবের মুখে শুনেছি (জায়নের দাদা পারুল চৌধুরী) পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জায়ানের মুখে পবিত্র কোরআনের সুরা আর-রাহমান তেলাওয়াত শুনতেন। এই সুরাটি জায়ান খুব সুন্দর করে পড়তেন। তার তেলাওয়াত শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে তার খুব প্রশংসা করতেন।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বুনিয়াদী জমিদার পরিবারের নতুন প্রজন্মের ছোট্ট শিশু জায়ান। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিল দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। জমিদার ও রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও রাজনীতির আঁচ তার দেখা ছিল না। আর বৈশ্বিক রাজনীতির মারপ্যাঁচের সাথে তার ন্যূনতম সম্পর্কও হয়নি। ধর্ম বর্ণ রাষ্ট্র নিয়ে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ কিভাবে হয় তাও তার জানা ছিলনা।

সেই ভেদাভেদের আগুনে পুড়েই শেষ হয়ে যেতে হলে নিষ্পাপ শিশু জায়ানকে। হাসপাতালে এখনও ভর্তি তারা বাবা মশিউল হক চৌধুরী প্রিন্স।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জায়নের দাদা পারুল চৌধুরী তার আদরের নাতির লাশ আনতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। এসময় সাথে শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ আরো অনেকেই ছিলেন। দুপুরে আট বছরের নাতির নিথর দেহ নিয়ে বাসায় ফেরেন তারা। সেই বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। জায়ানের আত্মার শান্তি কামনায় সকাল থেকে কোরআন তেলাওয়াত করা হচ্ছে। বাসার কাছেই, যে মাঠে কেটেছিল জায়ানের শৈশব, সেখানেই তার জানাজার নামাজ আদায় করা হয়। গেটের পাশেই ছিল একটা ফুল গাছ, যে রাঙা ফুলের সুবাসে এতদিন জায়ান বিহব্বল হতো, বুধবার সেই ফুলও তাকে জানায় শেষ বিদায়।

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী শহিদুর রহমান তালুকদার, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হাসান সিরাজ চৌধুরী ও শাহ আলম দ্বীপ জানান, জায়ানের দাদা মতিনিুল হক চৌধুরী পারুল তাদের সাথে প্রিয় নাতীর কথা গল্প করতেন। নিজের গৌরব ও ঐতিহ্যের জমিদারি নিয়ে গল্প করতেন জায়ানের সাথে। হাওর ঘেরা গ্রামের বর্ণনা শুনে দাদার সাথে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া এবং ঘুরে ঘুরে হাওর আর গ্রামের পর গ্রাম দেখার আবদার ছিল নিহত জায়ানের।

পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ও প্রিয় নাতীর হাত ধরে নিজেদের জমিদারির সীমানা ঘুরে-ঘুরে দেখানো, গ্রামে থাকা রক্তের আত্মীয় এবং স্বজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সুপ্ত বাসনাও ছিল জায়ানের দাদার। নাতী প্রথমবারের মত গ্রামের বাড়ি আসবে তাই সপ্তাহখানেক আগে ভাটিপাড়া গ্রামে ছুটে এসেছিলেন দাদা মতিনুল হক চৌধুরী। বাড়ি এসে শ্রমিক লাগিয়ে নতুন করে চৌধুরী নিবাস সংস্কার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, বিদ্যুৎ সংযোগ, রাস্তাঘাট মেরামতের কাজ শুরু করেন।

বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন ফ্রিজ, আর বিদ্যুৎ ভোগান্তির আশঙ্কায় নতুন জেনারেটরসহ মূল্যবান আসবাবপত্র। কিন্তু নাতীকে নিজেদের জমিদারি দেখানোর সুপ্ত বাসনা অধরাই রয়ে গেল রোববারের বোমা হামলায় জায়ান চৌধুরীর নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে।


আরো সংবাদ



premium cement