২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

চাঁদ দেখায় আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগানোর চিন্তা

চাঁদ দেখায় আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগানোর চিন্তা -

ঈদুল ফিতর উদযাপনে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে গত মঙ্গলবার দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ধরনের সিদ্ধান্ত আসার পরিপ্রেক্ষিতে টনক নড়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের। চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে আরো আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা করছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ঈদের ছুটি শেষে অফিস শুরুর পরই এই নিয়ে বসে আলোচনা করার কথা জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় চাঁদ দেখা না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে তারাবিহর নামাজ পড়ার পর রাত সাড়ে ১০টায় চাঁদ দেখার বিষয়টি জানতে পারেন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী আলহাজ শেখ মো: আব্দুল্লাহ। এরপরই তিনি সংবাদটি দ্রুত যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে রাত ১১টায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে চাঁদ দেখা যাওয়ার কথা জানান। দু’টি সিদ্ধান্তই শরিয়তসম্মতভাবে দেয়া হয়েছে বলে জানান ধর্মপ্রতিমন্ত্রী। 

ধর্ম সচিব মো: আনিছুর রহমান গতকাল নয়া দিগন্তের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক অনেক প্রযুক্তি আছে। আমরা সামনে সেগুলো কিভাবে প্রয়োগ করা যায় চিন্তাভাবনা করছি। ঈদের ছুটি শেষে এ নিয়ে আমরা আলোচনা করব। 

চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠকে অংশ নেয়া দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম মাওলানা মাহফুজুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ওই দিনের ঘটনার পরই চাঁদ দেখার বিষয়টিকে কিভাবে আরো আধুনিক, উন্নত ও সহজ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা আসছে। তবে শরিয়তের মধ্যে থেকেই চাঁদ দেখার বিষয়টিকে আধুনিক ও উন্নত করার কথা বলব আমরা। 
এ বছর রমজান শেষে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির দুই ধরনের সিদ্ধান্তে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন দেশের মানুষ। তৈরি হয় বিভ্রান্তিও। অনেকে সংবাদমাধ্যম অফিস ও সাংবাদিকদের ফোন করে প্রকৃত খবর জানারও চেষ্টা করেন।

গত মঙ্গলবার ২৯ রমজান বায়তুল মোকাররমে চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠক থেকে প্রথমে রাত ৯টায় ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা না যাওয়ায় রমজান মাস ৩০ দিন পূর্ণ হয়ে ৬ জুন পবিত্র ঈদুল ফিতর পালিত হবে। ঘোষণা দেয়ার পর প্রতিমন্ত্রীসহ চাঁদ দেখা কমিটির সদস্যরা বায়তুল মোকাররমে তারাবিহর নামাজে অংশ নেন। নামাজ শেষ করে প্রতিমন্ত্রীসহ সবাই চাঁদ দেখার জোরালো খবর জানতে পারেন। এরপরই শুরু হয় দ্রুত তা যাচাইয়ের কার্যক্রম। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর মিডিয়াকে খবর দিয়ে রাত সোয়া ১১টায় চাঁদ দেখা যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়, ৫ জুন বুধবার ঈদুল ফিতর উদযাপন হবে। টেলিভিশন, অনলাইন ও সর্বোপরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সুবাদে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পরিবর্তিত খবর। অনেক মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়েও জানানো হয়। তবে তার আগেই সারা দেশের মানুষ পরদিনের রোজা পালনের প্রস্তুতির অংশ নিয়ে তারাবিহর নামাজ আদায় করেন। অনেক পরিবারে রাতের সাহরির রান্নাবান্নাও হয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় ঘোষণায় অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়েন।

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সদস্যরা বলছেন, দু’টি সিদ্ধান্তই শরিয়তসম্মতভাবে নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ ছিল না। প্রথমে রাত ৯টা পর্যন্ত চাঁদ দেখার প্রামাণিক কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে সে হিসেবেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পরে চাঁদ দেখার বিষয়ে প্রামাণিক খবর পাওয়া যাওয়ার পরই বিলম্ব না করেই নতুন ঘোষণা দেয়া হয় এবং সেটিই কার্যকর হয়। 
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসাইন জানান, চাঁদ দেখা না যাওয়ায় প্রথম ঘোষণাও বিলম্বিত করা হয়। প্রথম দফা ঘোষণায় চাঁদ না দেখার ঘোষণা দেয়ার পরই যারা চাঁদ দেখেছেন তারা সংবাদ পাঠাতে শুরু করেন। এরপর সংবাদগুলো যাচাই করা হয়। সর্বশেষ কুড়িগ্রামের ডিসি লিখিতভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করার পরই রাতে নতুন সিদ্ধান্ত জানানো হয়। 
ধর্ম সচিব মো: আনিছুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, চাঁদ দেখার খবরটি আমাদের কাছে বিলম্বে আসার কারণ হচ্ছে, যারা চাঁদ দেখেছেন তারা খবরটি তাৎক্ষণিকভাবে আমাদেরকে জানাননি। আমরা প্রথমে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম সেটি আমরা যে পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত দিই সে পদ্ধতিতেই দিয়েছিলাম। এরপর এশা ও তারাবিহর নামাজের সময় হওয়ায় আমরা সবাই নামাজ পড়তে চলে যাই। পরে যখন আমরা চাঁদ দেখার কথা জানলাম তারপর আমরা সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দিলাম। 

চাঁদ দেখা কমিটির গত মঙ্গলবারের বৈঠকে অংশ নেন শায়খুল হাদিসের ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনিই তারাবিহর নামাজ পড়া অবস্থায় প্রথমে মোবাইল ফোনে মেসেজের মাধ্যমে চাঁদ দেখার বিষয়টির খবর পান এবং নিজে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররমে অবস্থানরত ধর্মপ্রতিমন্ত্রী, ধর্ম সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জানান। 

মাওলানা মাহফুজ এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তকে বলেন, চাঁদ দেখার বিষয়টি প্রথমে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই প্রথম ঘোষণাও দেরি করা হয়। আমাদের ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট যাদের বড় ধরনের নেটওয়ার্ক আছে সবার সাথে কথা বলার পরই পৌনে ৯টায় ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর বায়তুল মোকাররমে কিছুটা বিলম্বে ৯টা ৫ মিনিটে এশার নামাজ শুরু হয়, তারপর তারাবিহ। তারাবিহরত অবস্থায় আমার কাছে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে একটি মেসেজ আসে। তাতে বলা হয়, জরুরি ভিত্তিতে চাঁদ দেখার বিষয়ে আমি যেন হাটহাজারী মাদরাসার মুফতি জসিম উদ্দিন সাহেবের সাথে কথা বলি। তখন আমি নামাজ থেকে বের হয়ে একান্তে মুফতি জসিম উদ্দিনের সাথে কথা বলি ফোনে। তিনি জানান, কুড়িগ্রামের দুই জায়গা এবং মাদারীপুর থেকে চাঁদ দেখা যাওয়ার নির্ভরযোগ্য খবর এসেছে। এই সংবাদ আসে চাঁদ দেখা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার কিছুক্ষণ পরে। যেহেতু সংবাদটি পরে আসে সে জন্য সেটি যাচাই করা ও তাহকিক করা জরুরি। আমি নামাজ শেষে উপস্থিত ধর্মপ্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ সবাইকে সেটি জানালাম এবং সবাইকে আবার বসার পরামর্শ দিলাম। এরই মধ্যে মারকাজুল দাওয়ার মুফতি আব্দুল মালেক সাহেবও লালমনিরহাটে চাঁদ দেখা যাওয়ার কথা জানান। এরপর দ্রুত হেলাল কমিটির সবাই বসেন। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসিদের খবর দেয়া হলে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের ডিসিরা ওই ব্যক্তিদের সাথে সরাসরি কথা বলে এর সত্যতা নিশ্চিত করেন। এসবের ভিত্তিতে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শফীসহ বেশ কয়েকজন আলেমের সাথে কথা বলেন। এরপর সবাই আলাপ-আলোচনা করে চাঁদ দেখা যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই এবং সেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। 

মাওলানা মাহফুজ বলেন, চাঁদ দেখার বিষয়টি কিভাবে আরো আধুনিক করা যায়, এটা হয়তো সামনে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, চাঁদ দেখার বিষয়টিকে আধুনিক করলেই শুধু হবে না; সেটি কিন্তু শরিয়তসম্মত হতে হবে। আমরা বলব দুটো বিষয়ই থাকতে হবে। 
ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট শেখ মো: আব্দুল্লাহ এ ঘোষণা প্রদান করেন। এ সময় ধর্ম সচিব মো: আনিছুর রহমান, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মু: আ: হামিদ জমাদ্দার, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নূরুল ইসলাম, সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়ার অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: আলমগীর, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ মিজানুর রহমান, ঢালকানগর জামিয়া হাকিমুল উম্মতের মহাপরিচালক ও শায়খুল হাদিস মাওলানা আব্দুল মতিন পীর সাহেব, জামেয়া রাহমানিয়ার প্রিন্সিপাল মুফতি মো: মাহফুজুল হক, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহ মো: মিজানুর রহমান ও লালবাগ শাহী জামে মসজিদের খতিব মুফতি মুহাম্মদ নিয়ামতুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement