২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাহরাইন দূতাবাসে লাশ পরিবহনের টাকা নেই মানবেতর জীবন ২৯৫ কর্মীর

বাহরাইন দূতাবাসে লাশ পরিবহনের টাকা নেই মানবেতর জীবন ২৯৫ কর্মীর - ছবি : সংগৃহীত

মধ্যেপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনে প্রতি বছর গড়ে শতাধিক বাংলাদেশী শ্রমিক বিভিন্ন কারণে মারা যাচ্ছেন। প্রবাসী এসব কর্মীর লাশ দেশে পাঠাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের ফান্ডে নেই। যার কারণে বেশির ভাগ সময় হতভাগ্যদের লাশ পাঠাতে দূতাবাস কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হয়। কখনো কখনো কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের কাছে হাতও পাততে হচ্ছে তাদের। 

অভিযোগ রয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিলে বিদেশগামী প্রত্যেক কর্মী সরকার নির্ধারিত (কল্যাণ ফান্ড) টাকা জমা দিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার পর দুঃসময়ে তারাই তাদের জমানো টাকা অসুস্থতার জন্য কিংবা মৃত্যুর পরও পাচ্ছেন না। এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও সংশ্লিষ্টদের যেন মাথাব্যথা নেই। 

সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মানামাস্থ আল মিরজা রোড সংলগ্ন পুরনো একটি ভবনের তৃতীয় তলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ভবনের একাংশ ধসে চারজন নিহত ও প্রায় অর্ধশত বাংলাদেশী আহত হন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ অন্য উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন। তার আগে আহতদের উদ্ধার করে সালমানিয়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। 

এ ঘটনার পর বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল কে এম মমিনুর রহমান (অব:) প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাসের কাছে জরুরি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তিনি ভবন বিধ্বস্ত হয়ে নিহতদের লাশ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো এবং অসুস্থ ও বিপদগ্রস্ত কর্মীদের আর্থিক সাহায্যর জন্য জরুরি ভিত্তিতে অতিরিক্ত আরো ১২ লাখ টাকার বাজেট প্রয়োজন বলে জানান। 

২২ নভেম্বর পাঠানো দূতাবাসের চিঠিতে বলা হয়, সালমানিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দূতাবাস কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, বর্তমানে ১৩ বাংলাদেশী কর্মী চিকিসাধীন আছেন। এর মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মধ্যে ১৬ কর্মীকে চিকিৎসা শেষে রিলিজ দেয়া হয়েছে। ওই ভবনে অবস্থানকারী ২০ জন বাংলাদেশী কর্মী লিন্নাস মেডিক্যাল সেন্টারসহ নিকটবর্তী অন্যান্য হাসপাতাল/ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে দুইজনকে অধিকতর চিকিৎসার জন্য বিডিএফ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ওই ভবনে বসবাসকারী আরো ৯৫ জনের বেশি বাংলাদেশী কর্মী বর্তমানে আশ্রয়হীন অবস্থায় রয়েছেন। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির দুই পাশের দুইটি ভবন থেকে আরো প্রায় ২০০ জন বাংলাদেশী কর্মীকে নিরাপত্তার অজুহাতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। জানমালের নিরাপত্তার জন্য দুর্ঘটনার পর ওই ভবনটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হলেও শ্রমিকেরা তাদের টাকা পয়সা ও মূল্যবান মালামাল সরাতে পারেননি। যার কারণে তারা বর্তমানে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দুর্ঘটনার পর দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উদ্ধার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা তদারকি করেন। আশ্রয়হীন কর্মীদের কাপড়চোপড়, জুতা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র প্রদান করেন।

চিঠিতে রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, দুর্ঘটনায় নিহত চার কর্মীই বাহরাইনে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বসবাস করে আসছিলেন। তাই তাদের লাশ দেশে প্রেরণের খরচ ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের আর্থিক সহযোগিতায় দূতাবাস থেকে বহন করতে হবে। বাহরাইন থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশ প্রেরণে পরিবহন খরচ হয় ৪৩০ দিনার (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় এক লাখ টাকা)। আবার বাহরাইন থেকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশ পাঠালে খরচ হয় ৫৩০ দিনার (এক লাখ ২৫ হাজার টাকা)। লাশ পরিবহনে (চলতি অর্থবছর) প্রায় ৪ লাখ টাকা অবশিষ্ট আছে। যার পুরোটাই দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ পরিবহনে ব্যয় করতে হবে। ২০১৮-২০১৯ সালে লাশ পরিবহনের জন্য দূতাবাসের বাজেট ৫ লাখ টাকা।

গতকাল বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, ভবন বিধ্বস্তের ঘটনায় মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এরা সবাই অবৈধ হিসেবে এ দেশে কাজ করছিলেন। এর মধ্যে চারজন ঘটনার দিন মারা যান। তাদের লাশ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। একজনের লাশ হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। তার নাম সম্ভবত শামীম। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, শামীমের লাশের কন্ডিশন খুব খারাপ। তাই আমরা তার লাশ এ দেশে দাফন করতে পরিবারের সম্মতি নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছি। 

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিহত চার বাংলাদেশী শ্রমিক অবৈধ হলেও বাহরাইন সরকার ডেডবডি বাংলাদেশী কর্মীর কি না সেটি নিশ্চিত হলেই ক্লিয়ারেন্স (এনওসি) দিয়ে দেয়। হতাহতদের মধ্যে বাংলাদেশী কতজন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন মাত্র ইন্ডিয়ান ছাড়া বাকি সবাই বাংলাদেশী। লাশ প্রেরণ ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও সাহায্যর জন্য ১২ লাখ (লাশ পরিবহন ৫ লাখ+ ৭ লাখ) টাকা ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের কাছে চেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ টাকা দিয়ে কিছুই হবে না। দুর্ঘটনাসহ ক্রাইসিস মুহূর্তে কমিউনিটিও এগিয়ে আসে। দূতাবাস থেকে কর্মীদের লাশ দেশে প্রেরণের জন্য চিঠি দেয়ার সাথে সাথে ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে টাকা (ফান্ড) চলে এসেছে তিনি বলেন, এক বছরে আমাদের পাঁচ লাখ টাকা লাশ পরিবহনের জন্য বাজেট দেয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে কিছুই হয় না।

একজনের লাশ পাঠাতে এক লাখ টাকা লাগে। গত বছর ১২০ জন মারা গেছেন। আর এ বছর তো ১২০ জনেরও বেশি মারা গেছেন। লাশ পাঠানোর বেশির ভাগ টাকাই আত্মীয়স্বজন ও কমিউনিটি থেকে ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ করে আমাদের তুলতে হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement