২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
প্রজনন ত্রে রায় ৯ দফা সুপারিশ

হালদা নদীতে ভেসে আসা মরা মাছের বেশির ভাগ দুই পাড়ের প্লাবনভূমি থেকে আসা

-

দেশের রুই জাতীয় নিষিদ্ধ ডিম আহরণ উপযোগী একমাত্র নদী হালদা নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর নয় এমন প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে অভিযোগ করে একোয়াটি রিসার্চ গ্র“প বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে নদীটিতে ভেসে আসা মরা মাছগুলোর বেশির ভাগই দুই পাড়ের প্লাবনভূমি থেকে আসা। তা ছাড়া বড় বড় রুই-কাতলা মানেই ভালো মা-মাছ নয় বলে গবেষণাধর্মী এ গ্র“পটি জানিয়েছে। হালদা নদীর কার্প (রুই জাতীয়) মাছ এবং প্রজনন ত্রে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একোয়াটিক রিসার্চ গ্র“প ৯ দফা সুপারিশ করেছে। ‘হালদার দুই কূলে বন্যা বিপর্যয়, হালদার বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পে এসব সুপারিশ তুলে ধরেন ৪০ বছর ধরে হালদা নদী ও এর মৎস্য সম্পদ নিয়ে গবেষণারত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী। সম্প্রতি চট্টগ্রাম প্রেস কাবে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন সরকারি সিটি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান এবং হালদা নদীর ওপর প্রথম পিএইচডিধারী ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম, চট্টগ্রাম কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো: ইকবাল, ফেনী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইউনুচ হাসান, প্রফেসর সুনীল চন্দ্র পাল, চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফতাব হোসেন ও সৈয়দা ইসমত আরা।
লিখিত বক্তব্যে ড. আজাদী বলেন, গত মাসের ভয়াবহ বন্যার প্রভাবে হালদা নদীর প্রাণিজ জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, হালদা কর্ণফুলী নদীর শাখানদীগুলোর মধ্যে একটি টাইডাল শাখা নদী। যেখানে ৪ প্রজাতির মেজর কার্প (কাতলা প্রায় ৯০ শতাংশ, মৃগেল ও রুই ৯.৫ শতাংশ এবং কালিবাউস ০.৫ শতাংশ) এপ্রিল-জুন মাসে বৃষ্টিসহ আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ডিম পাড়ে। মানবসৃষ্ট কারণ আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রুই-কাতলার প্রাকৃতিক প্রজনন ত্রে হালদা আজ হুমকির সম্মুখীন।
হালদায় মাছ মরার কারণ
গত জুন মাসের শেষের দিকে হালদা নদীতে ভেসে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মরা মাছের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ড. আজাদী বলেন, শুধু শিল্পকারখানার বর্জ্য মাছ মরার জন্য দায়ী নয়। তিনি বলেন, প্রবল বন্যার সময় স্রোতের প্রচণ্ড বেগে নদীর উপরের বর্জ্য নিচে নেমে যাওয়াই স্বাভাবিক, তখন নিচের বর্জ্য স্রোতের বিপরীতে উপরে আসার সুযোগ নেই। যদি নিচের বা আশপাশের বিভিন্ন কারখানার বর্জ্যরে কারণে মাছ মরত তাহলে প্রতিদিন ভাটার সময় যখন পানি কম থাকে এবং অন্য দিকে জোয়ারের সময় পানির তরলতা (ডাইলিউশন) বন্যার মতো নয়, তখন অর্থাৎ বন্যার আগের দিন পর্যন্ত হালদা নদীতে ব্যাপক হারে মাছ মরে ভেসে যেত কিন্তু সে ধরনের রেকর্ড নেই।
ড. আজাদী বলেন, গেল জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে লাগাতার ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় ভয়াবহ বন্যার রূপ নেয়। বন্যার পানিতে হালদার প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার দুই কূলের জমি (ফসলি এবং আগাছা ভর্তি), মানুষের ঘরবাড়ি, সার্ভিস/স্যানিটারি ল্যাট্রিন, ময়লার স্তূপ, হাটবাজার, পোলট্রি খামার, বর্জ্য পয়ঃপ্রণালীসহ মাছ চাষের সব পুকুর তলিয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় এলাকার লাখ লাখ লোকের শরীর নির্গত বর্জ্য (তরল এবং সেমি সলিড)। ১০-১২ দিন ধরে সবধরনের জৈব/অজৈব বস্তু পানির তলায় পচে পানিকে বিষাক্ত বোমে রূপান্তর করে। যার ফলে জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা (বিওডি) চরমভাবে বেড়ে যায়। তখন পুকুর থেকে বের হয়ে আসা পচা পানিতে বিভিন্ন জাতের ছোট-বড় মাছ (তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, আইর, রুই–কাতলা, চিংড়ি, কাকড়া সহ সব জলজ প্রাণী) অক্সিজেন ও খাদ্যের অভাবে এবং বিষাক্ত পানির বিষ ক্রিয়ায় মারা যায়। মরা মাছ প্রথমে পানিতে ডুবে পচে আবার ভেসে উঠে তখন পানির বিওডি আরো বেড়ে যায়। পরে পানি কমতে শুরু করলে স্রোতের টানে এসব মাছ বিভিন্ন খাল দিয়ে হালদায় নেমে এসে স্রোতের প্রবল টানে ভাটিতে নিচে চলে যায়। শুরু থেকেই হালদায় প্রচণ্ড স্রোত থাকায় হালদার মাছ আগেই স্রোতের বেগে ভাটিতে নিচে কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন সংযোগ নদীতে চলে যায়। তবে কিছু মাছ হালদায় থেকেও মরে যায়- যারা অতি স্রোতে অ্যাডাপটেড নয়।
হালদায় ডিম কম ছাড়ার কারণ
‘বালু উত্তোলন (ম্যানুয়ালি), লবণাক্ততা এবং মানিক ছড়িতে তামাক চাষের প্রভাবে হালদায় মা মাছের ডিম না ছাড়ার কারণ হিসেবে যে প্রচার আছে তা ধারণানির্ভর, পরীানির্ভর নয়’ উল্লেখ করে আজাদী বলেন, ডিম কম ছাড়ার প্রকৃত কারণের মধ্যে রয়েছেÑ হালদার ২০ কিলোমিটার প্রজনন এলাকায় (সত্তার ঘাট-মদুনা ঘাট) ৫টি প্রজনন ত্রে বা বাঁক কাটা, হালদার ১৬টি উপখালে স্লুইস গেট নির্মাণ, পাড়ে ৪০ কিলোমিটার বাঁধ, উজানে দুইটি রাবার ও একটি ওয়ের ড্যাম নির্মাণ, মা-মাছ অতি আহরণ, দুই পাড়ের নিকটস্থ বা অদূরে অবস্থিত কল-কারখানার বর্জ্য, পোলট্রির বর্জ্যসহ সব বর্জ্য হালদায় বিভিন্ন খালের মাধ্যমে নিপে করা।
এ বছর ডিম বৃদ্ধির কারণ
ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, ‘আমাদের পর্যবেণে ছিল ডিম পাড়া এবং রেণু উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ‘জলজ এবং বায়বীয় আবহাওয়া (ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক) ডিম ছাড়ার অনুকূলে থাকা, পর্যাপ্ত মা-মাছ, ডিম আহরণকারীরা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় অবস্থান এবং ডিম ফোটানোর ও রেণু প্রতিপালনে ব্যবস্থাপনা (মাটির কুয়া, সরকারি হ্যাচারি, পানি সরবরাহ ইত্যাদি।
হালদা রায় সুপারিশ
এ দিকে হালদা রায় ড. আজাদী নয় দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ‘হালদা স্টক মেজর কার্পের বংশগতি রার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলায় সরকারি হ্যাচারিতে হালদা কার্প ব্র“ড ব্যাংক প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করা এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় জিন ব্যাংক স্থাপন করা। ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হালদা ‘স্টক মেজর কার্প’ লুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রায় এ উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
হালদার দূষণ রোধে কল-কারখানার বর্জ্য ট্রিটমেন্টের জন্য ইটিপি স্থাপন ছাড়া নতুন কোনো কল-কারখানার অনুমোদন না দেয়া এবং ইতঃপূর্বে স্থাপিত কলকারখানাগুলোতে দ্রুত ইটিপি স্থাপনে সময় বেঁধে দেয়া।
‘মুরগি ফার্মের বর্জ্য, মানববর্জ্যসহ সব অজৈব/জৈব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ‘হালদা সংযুক্ত কর্ণফুলী, সাঙ্গু, শিকলবাহা, চাঁদখালী খাল ও হালদার ১৬টি উপখালে ফেব্র“য়ারি-জুলাই পর্যন্ত মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা। হালদা সম্পর্কিত সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পরিকল্পনা করা। ডিম প্রাপ্তি বৃদ্ধির জন্য ‘কার্প ফিংগারলিং স্টকিং প্রোগ্রাম’ গ্রহণ। এ েেত্র হালদার পোনা বড় করে প্রতি বছর হালদায় ছাড়া। একই সাথে বর্তমানে কালিবাউশ অত্যন্ত কম বা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় রুই, মৃগেল ও কাতলের চেয়ে কালিবাউশের বেশি স্টক করা। দা পাড়ে সরকারি হ্যাচারিগুলোয় ডিম ফোটানোর হার বৃদ্ধির জন্য ভালো পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং ভালো পুকুর স্থাপন। হালদার ভরাট এলাকার এবং ভরাট হয়ে যাওয়া হালদার উপ-খালগুলোর জন্য সীমিত আকারে ড্রেজিং প্রয়োজন আছে কিনা তা জেনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাস্তব নদী-প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ এবং সত্যিকার কার্প বায়োলজিস্টদের পরামর্শ গ্রহণ। ‘হালদার উজানে দুইটি রাবার ড্যাম এবং একটি ওয়ের ড্যামের ফলে হালদায় শুষ্ক মওসুমে কী পরিমাণ পানি উইৎড্র হয় তাতে হালদার জীববৈচিত্র্যের এবং কার্পের ব্রিডিংয়ের তির জরিপ করা।


আরো সংবাদ



premium cement